ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

বাংলার নতুন মহাকাব্যের নাম পদ্মাসেতু

সম্পাদকের কলম

 প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২২, ১২:০৩ রাত  

ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতুতে যান চলাচলের জন্য উদ্বোধন করবেন শনিবার (২৫ জুন)। এতে প্রতীক্ষার যে দীর্ঘ সময় পার করতে হয়েছে তার অবসান হবে। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে রচিত হচ্ছে দেশে অমর এক মহাকাব্য। এই মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই বানাতে হয়েছে পদ্মাসেতু। এই সেতু তৈরির মধ্যদিয়ে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি হলো। ভোরের সূর্য যখন উদয় হবে তখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশে পদ্মাসেতু উদ্ধোধনকে কেন্দ্র করে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। অবশ্য উদ্বোধন উপলক্ষে কয়েকদিন ধরেই আনন্দ লহরী বয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে অবশ্য চট্টগ্রামরে শীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড, সিলেটের ভয়াবহ বন্যা বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করে। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে পদ্মাসেতু উদ্বোধন সবার মনযোগ কেড়ে নেয়। দেখতে দেখতে শেষ হয়েছে বছর, মাস ও দিনের গণনা। এবার শুরু হয়েছে ঘণ্টা গণনা। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দেশের ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতু।

এজন্য আজকের রাতটি পেরোনোর অপেক্ষা মাত্র। সাড়ে ছয় বছরের নির্মাণ বুননে পদ্মার দুই পাড় এক করতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো স্বপ্নের সেতুটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে শনিবার সকালে। পদ্মাসেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন করার কথা থাকলেও ব্যাংকটি মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্দন ছিলো। তারাই নানা কারসাজি করে পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির গল্প ফাঁদে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। পদ্মাসেতুকে যাতে নির্বিঘ্নে উদ্বোধন না করা যায়, সেই লক্ষে ধারাবাহিকভাবে দেশে নাশকতা চালানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত তারাই যারা পদ্মাসেতু নির্মাণের বিরোধীতা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত কোনো নাশকতাই সেতুর উদ্বোধনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

দীর্ঘতম সেতুটির উদ্বোধনের ফলে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে দাঁড়ানো সেতুটির উদ্বোধনকে ঘিরে সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। প্রতিটি জেলায় উৎসব করতে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীও সেজেছে নতুন আমেজে। মানুষের মধ্যে অন্যরকম উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।

সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশি-বিদেশি অতিথিদের। দেশের বৃহত্তম পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। এই সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে যুক্ত করবে। মাওয়া প্রান্তে সেতু উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন সরকারপ্রধান। এরপর বিকেলে মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ঘাট এলাকায় জনসভায় বক্তব্য দেবেন শেখ হাসিনা।

সেতু উদ্বোধনকে ঘিরে শিবচরে ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। পদ্মাসেতুর এক্সপ্রেস হাইওয়ে সেজেছে বর্ণিল সাজে। বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় প্রস্তুত করা হয়েছে মঞ্চ। সেতুর টোলপ্লাজা থেকে কাওড়াকান্দি পুরনো ফেরিঘাট এলাকার চারপাশের আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাত শতাধিক মাইক লাগানো হয়েছে। লঞ্চের যাত্রী নামানোর জন্য নতুন করে বসানো হয়েছে ১৫টি পন্টুন। ৫০০ অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। খাওয়ার পানির জন্য বসেছে ৫০০ কল।

সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। র‌্যাবের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পদ্মাসেতু চালুর মধ্যদিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক উন্নতি হাতের মুঠোয় চলে আসবে। কতটা সুযোগ-সুবিধা বাড়বে তা একবার কল্পনা করলে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারা যায় না। পদ্মাসেতুর দুই পাড়েই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চারগুণ বেড়েছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পড়ে গেছে।

খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণশিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতগতিতে। আগামী দিনে বিকাশের এ ধারা আরো বেগবান হবে। পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে রেলের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট অবকাঠামোও স্থাপিত হবে। ফলে কলকাতার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের সময় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। এর প্রভাব বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।

পায়রা ও মংলা সমুদ্রবন্দরের পণ্যসেবার পরিমাণ বাড়বে। নতুন নতুন জাহাজ ভিড়বে। ইন্টারনেট সেবা সহজেই পেলে দক্ষিণাঞ্চলে ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সহজলভ্য হলে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশও ঘটবে। কৃষিসহ দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প-বাণিজ্যেও বিনিয়োগ বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। সেটা হলে এখন যে জলবায়ু চ্যালেঞ্জের শিকার অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক কাজকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে আসবে।

পদ্মাসেতুর ফলে দক্ষিণ বাংলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠবে। ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উৎকৃষ্ট হাট। ছুটি পেলেই ঢাকা ও অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবেন দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবেন কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবেন পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোয় গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট ও পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র।

সরকারও এরইমধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মাপাড়ের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে। পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। পদ্মাসেতুর কাছেই দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মাসেতুর আশপাশে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। জাতির পিতার সুযোগকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতু নির্মাণ করে দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। তাকে অশেষ ধন্যবাদ।

দৈনিক সরোবর/এমকে