যুদ্ধবিরতিতে পুতিন শর্তসাপেক্ষে রাজি
প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৯:০২ রাত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি আছেন, তবে এর সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিতে চান তিনি। শেষ পর্যন্ত কী কী শর্ত দেবেন এবং সেগুলোর পর শান্তি চুক্তির বিষয়টি কী দাঁড়াবে সেব্যাপারে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। এদিকে, পুতিনের প্রতিক্রিয়াকে 'ধুর্ততা' হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়ানোর দাবি তুলেছেন।
গত মঙ্গলবার সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হয় ইউক্রেন, এ ব্যাপারে নিজের মত জানাতে গিয়ে শর্তের কথা বলছিলেন পুতিন।
এরইমধ্যে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও ব্যাংক খাতে আরো কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৃহস্পতিবার মস্কোয় এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, ধারণাটি সঠিক এবং আমরা এটিকে সমর্থন করি, তবে এমন প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করা দরকার। যুদ্ধবিরতি এমন হওয়া উচিত যা একটি স্থায়ী শান্তির দিকে পরিচালিত করবে এবং এই সংকটের মূল কারণগুলো দূর করবে। আমাদের আমেরিকান সহকর্মী এবং অংশীদারদের সাথে আলোচনা করতে হবে। সম্ভবত আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলবো।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনের জন্য ভালো হবে। আমরা এর পক্ষে। তবে এর কিছু অস্পষ্টতাও রয়েছে।
বিবাদের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল, পুতিন বলেছেন, যেখানে ইউক্রেন গত বছর একটি সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছিল এবং কিছু অঞ্চল দখল করেছিল।
তিনি দাবি করেছেন, রাশিয়া সম্পূর্ণরূপে কুরস্কের নিয়ন্ত্রণে ফিরে পেয়েছে এবং সেখানে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের ‘কোণঠাসা’ করা হয়েছে। তারা চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমরা নিয়ন্ত্রণে আছি। তাদের সরঞ্জামগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। কুরস্কে ইউক্রেনীয়দের জন্য দুটি বিকল্প রয়েছে––আত্মসমর্পণ করা অথবা মৃত্যু।
যুদ্ধবিরতি কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে কিছু প্রশ্নের রূপরেখা তুলে ধরে পুতিন জিজ্ঞেস করেন, ৩০ দিনের এই সময়টা কীভাবে কাজে লাগবে? ইউক্রেনকে সংগঠিত করার জন্য? পুনরায় অস্ত্র দিতে? মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে? নাকি এর কোনোটিই নয়? তারপরের প্রশ্ন- কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে? যুদ্ধ শেষ করার নির্দেশ কে দেবে? কী মূল্যে? কে সিদ্ধান্ত নেবে যে দুই হাজার কিলোমিটারেও বেশি এলাকায় কে কোন সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে? এই সমস্ত প্রশ্নের জন্য উভয় পক্ষের সূক্ষ্মভাবে কাজ দরকার। এসবের নীতি কে ঠিক করবে?
পুতিন ‘সরাসরি না বলেননি’ এই কথা উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলছিলেন, আসলে তিনি প্রত্যাখ্যানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পুতিন অবশ্যই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি বলতে ভয় পাচ্ছেন যে তিনি এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান এবং ইউক্রেনীয়দের হত্যা করতে চান।
রাশিয়ান নেতা এতগুলো পূর্ব-শর্ত বেঁধে দিয়েছেন যার ‘ফলে কিছুই কার্যকর হবে না,’-যুক্ত করেন জেলেনস্কি।
পুতিনের মন্তব্য এবং এ বিষয়ে জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়ার পরে এখন উভয় পক্ষের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে।
ইউক্রেন একটি দুই স্তরের একটি প্রক্রিয়া চায়––প্রথমে একটি দ্রুত যুদ্ধবিরতি এবং এরপর একটি দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তির আলোচনা।
রাশিয়া বিশ্বাস করে, এই দুটি প্রক্রিয়া আলাদা করা সম্ভব না এবং সব সমস্যা একটি একক চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা।
উভয় পক্ষকে তাদের নিজ নিজ চুক্তির পক্ষে তর্ক চালিয়ে যাওয়ার শক্ত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে।
ইউক্রেন বিশ্বাস করে, তারা রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে রাশিয়াকে শান্তির বিষয়ে অনিচ্ছুক এবং সময় ক্ষেপনের চেষ্টাকারী হিসেবে দেখাতে চায়।
এদিকে রাশিয়া বিশ্বাস করে যে নেটো সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তার মৌলিক উদ্বেগগুলো উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে এখন।
তবে এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একটি সমস্যা। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে তিনি দ্রুত ফলাফল চান, কয়েক দিনের মধ্যে লড়াই শেষ করতে চান।
যদিও ট্রাম্প বলেছিলেন, বল এখন রাশিয়ার কোর্টে, কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বলছে পুতিন হয়তো বল খেলতে চান না।
পুতিনের মন্তব্যের পর হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং তিনি আশা করেছিলেন রাশিয়া সঠিক কাজ করবে ও প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে। আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধবিরতি দেখার আশা করছি।
এর আগে নেটো মহাসচিব মার্ক রুটের সাথে ওভাল অফিসে এক বৈঠকে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি ইতিমধ্যে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধবিরতির সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘আমরা ইউক্রেনের ভূখণ্ড এবং এই ভূখণ্ডের কোন কোন অংশ থাকবে আর কোন অংশগুলো বাদ যাবে–– এগুলোসহ চূড়ান্ত চুক্তির অন্যান্য উপাদানগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।চূড়ান্ত চুক্তির অনেক বিষয় নিয়ে এরইমধ্যে আসলে আলোচনা হয়েছে।
নেটো সামরিক জোটে ইউক্রেনের যোগদানের বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, এর উত্তর কী সেটা সবাই জানে।
রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা এমন এক সময় এসেছে যখন ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন পেমেন্ট সিস্টেমগুলোয় প্রবেশাধিকার আরও সীমাবদ্ধ করেছে, যার ফলে অন্যান্য দেশের জন্যও রাশিয়ান তেল কেনা কঠিন হবে।
এদিকে, পুতিন মস্কোতে মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন।
আগের দিন, ক্রেমলিনের সহযোগী ইউরি উশাকভ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
বুধবার ক্রেমলিন একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যায় পুতিন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। তিনি তখন সামরিক পোশাক পরা ছিলেন।
এরপর রাশিয়া জানায়, যে তারা ওই এলাকার অন্যতম শহর সুদজা পুনরুদ্ধার করেছে।
রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করে এবং এখন তারা দেশটির ২০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইউক্রেন সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের হতাহতের পরিসংখ্যান জানিয়েছিল। তখন ভলোদিমির জেলেনস্কি সেনা ও সামরিক কর্মকর্তাসহ ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছিলেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন এই সংখ্যা হয়তো আরও বেশি।
যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর হয়ে লড়াই করা ৯৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা
দৈনিক সরোবর/এএস