ক্লিনিকগুলোয় ওষুধের মজুদ সংকট
প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২৫, ০৭:১৮ বিকাল

দেশের স্বাস্থ্য খাত পড়েছে অর্থ সংকটে। চলতি অর্থবছর দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনায় অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত জুনে এটি অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। এখনো সেটি হয়নি। ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের ৩৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি। এর মধ্যে অন্যতম সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, বিকল্প চিকিৎসা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জাতীয় স্বাস্থ্য ভয়াবহ সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগে যেসব রোগ নির্মূল করা গেছে, সেগুলো আবারও বাড়বে। একই সঙ্গে বিগত বছরগুলোয় স্বাস্থ্যে যত বিনিয়োগ করা হয়েছে তা আর কোনো কাজে আসবে না। দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ, বেতন দেওয়া এবং সব সেবা চলে ওপির অর্থে। ক্লিনিকগুলোয় মজুদ থাকা ওষুধে এরই মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, হেপাটাইটিস, ডেঙ্গু, এইডস, জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতো কার্যক্রম।
কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথকেয়ার প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, চার মাস ধরে তারা বেতন পাচ্ছেন না। এতে সিএইসপিদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের মজুত ফুরিয়ে এসেছে। অন্য আনুষঙ্গিকও প্রায় শেষ। এ অবস্থায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এখন তারা সেই অপেক্ষায় আছে।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গর্ভবতী ও কিশোরীদের জন্য জরুরি ফলিক এডিস ও আয়রন ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রশিদ বলেন, ‘৩৪ ওপির আলাদা আলাদা কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় আছে ১০টি। যার মধ্যে রয়েছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, হেপাটাইটিস, ডেঙ্গু, এইডস, জ্বলাতঙ্ক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতো কার্যক্রম। বর্তমানে এসব কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে।’ তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করায় দেশে কিছু রোগ নির্মূল হয়েছে এবং কিছু রোগ কমে আসছিল।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরামর্শক ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন- যে ওষুধ মজুত আছে, এতে আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু সারা দেশের নিয়োগকৃত টেকনোলজিস্ট, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং গাড়ির জ্বালানি গত জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ওপি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন ওপি না হওয়া পর্যন্ত পুরোনো ওপির বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে হবে রোগীর স্বার্থে। অন্যথায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যর্থ হবে।
বিনা বেতনে দিন কাটছে ১৪ হাজার সিএইচসিপির; বেতন নেই আউটসোর্সিং কর্মীদের
সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওপি অনুমোদন না করা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। কারণ শিশুদের টিকা, জরুরি ওষুধ, নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ইত্যাদি জরুরি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদন করা উচিত। বাকি বড় প্রকল্প ও উন্নয়নকাজগুলো এক দুই সপ্তাহের মধ্যে রিভিউ করে গুরুত্ব বিবেচনায় বাদ দেওয়া বা পরবর্তী সময়ে অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। যেহেতু রাজস্ব খাতে উন্নয়নমূলক কাজের কোনো বাজেট ধরা নেই; তাই ওপি অনুমোদন না করা হবে বড় ভুল।
একজন লাইন ডিরেক্টর বলেন, অপারেশনাল প্ল্যান না থাকায় এখন কোনো ডোনার এজেন্সিও সহযোগিতা করতে পারছে না। কারণ, প্রকল্প বা অপারেশনাল প্ল্যান ছাড়া উন্নয়ন খাতে টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া উন্নয়নকে কখনো রাজস্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অধিদপ্তরে কোনো ক্লিনার নেই। বন্ধ হয়ে গেছে প্রকল্পের পুরোনো গাড়িগুলোর জ্বালানি ও চালকের ব্যবস্থা। এই করুণ চিত্র শুধু অধিদপ্তরেই নয়, দেশের সব উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও। অর্থ বরাদ্দ না হলে এ বছর র্যাবিস (কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক) টিকা, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের টিকা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা কেনা হবে না। ফলে বিগত অর্থবছরে কেনা টিকার মজুত ফুরিয়ে গেলে দেশের মানুষকে এসব টিকা বাজার থেকে কিনে ব্যবহার করতে হবে। তবে এগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়ায় সবার পক্ষে সেটি সম্ভব হবে না। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বছরে দু’বার ভিটামিন এ ক্যাম্পেইন ও কৃমি নিয়ন্ত্রণ সপ্তাহ পালন একেবারে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ও রাতকানা নির্মূলে এই দুটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন অতি জরুরি। এছাড়া সাপে কাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনম, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়ার ওষুধ কেনাও পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না অ্যান্টিক্যানসার ওষুধ। সারা দেশের এনসিডি কর্নারগুলোও শূন্য প্রায়।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ইউএইচসি ওপি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হতো। সেটি এখন বন্ধ আছে। একইভাবে সারা দেশের উপজেলা হাসপাতালে অটো অ্যানালাইজার দেওয়া আছে। যেগুলোর রি-এজেন্ট না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ আছে। এছাড়া গাড়ির জ্বালানি ব্যয় এবং চালকের বেতনও বন্ধ আছে। ওপি অনুমোদন না হওয়ায় উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশে গত চার অপারেশন প্ল্যান (ওপি) তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বাভাবিক বরাদ্দ না থাকায় এমন কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে; যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এ সমস্যা যখন প্রকাশিত হতে শুরু করবে তখন শুধু আপসোস করতে হবে। হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান জীবনগুলো আর ফিরে পাব না। আগে প্রতি বছর পাঁচ লাখ শিশু মারা যেত। তাদের মধ্যে দেড় লাখ শিশু টিকার আওতায় যেসব রোগ আছে সেসব রোগে মারা যেত। একটা সময় পোলিও থেকে শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে যেত। অনেক শিশু ও মা ধনুষ্টংকারে মারা যেত। ইপিআই কর্মসূচির টিকার দ্বারা এসব মৃত্যু অনেক কমে এসেছে। ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জলাতঙ্ক এসব রোগের কোনোটি নির্মূল হয়েছে, কোনোটি নির্মূলের পথে। আমরা কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচি শুরু করেছিলাম ২০০৫ সালে। ২০ বছর লেগেছে নির্মূল হতে। এসব সম্ভব হয়েছে ওপির ধারাবাহিকতার কারণে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আমাদের ওপির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা উচিত। এখানে কিছু অপচয়, অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থাকতে পারে। এ দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। এর পাশাপাশি বরাদ্দ বাড়িয়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো অব্যাহত রাখা উচিত।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ