ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

নাগরিক সেবা বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় ইসি 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৮:৪০ রাত  

নির্বাচন ভবনের সামনে ‘স্ট্যান্ড ফর এনআইডি’ কর্মসূচিসহ মানববন্ধন করেন ইসি সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় ও মাঠ পযায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রমের সংবধানিক ক্ষমতা নিজের ঘরে রাখতে ঘাম ছুটছে নির্বাচন কমিশনের। নিজের অধীন নাগরিকদের ডেটা অথরিটি রাখার জন্য সরকারের কাছে সম্প্রতি সময়ে নানা অভিমত তুলে ধরেছে সংস্থাটি। এমনিতেই জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও নুতন দলের নিবন্ধণ ইস্যুতে সরব হয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। তারপর মানুষের মনে প্রবল জানার ইচ্ছ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে। আবার রাজনীতির মাঠে নির্বাচনকালীন রোড ম্যাপ নিয়ে তুকলোঘিকান্ড ও দলগুলোর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জনমনে জানার আগ্রহ আরও প্রবল হয়েছে। এর মধ্যেই এনআইডির নিজেদের অধীন রাখতে দেশব্যাপী ‘অপারেশনাল হল্ট’ কর্মসূচি পালন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানা গেছে, দেশের নাগরিকদের জন্য ব্যবহৃত জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার কার্ড নিজের অধীনে রাখতে ব্যাপক তোড়জোর চালাচ্ছে। এর মধ্যে এনআইডি সেবা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়বলি নিজেদের অধীনই রাখার পক্ষে মত দিয়েছে ইসি এবং এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে। এর আগে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম অন্য কোনো দপ্তর বা কর্তৃপক্ষের অধীন স্থানান্তর করা হলে ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এমএম নাসির উদ্দিন। তারপরও জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও নুতন দলের নিবন্ধণ ইস্যুতে সরব হয়েছে নির্বাচন কমিশন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে কর্মসূচি পালনকালে বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে আইন বাতিল করে এনআইডি সেবা ইসির অধীন রাখার বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি না পেলে আগামী বুধবার তিন ঘণ্টা অপারেশনাল হল্ট (কর্মবিরতি) কঠোর কর্মসূচি পালন করা হবে। তারপরও দাবি পূরণ না হলে কর্মবিরতিসহ আরো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, এনআইডি রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, এটি ইসির অধিকার; ইসির অধীন এনআইডি, জনগণের নিরাপত্তার গ্যারান্টিসহ তারা বিভিন্ন সেøাগান দিয়েছেন; এক দুই তিন চার, এনআইডির পিছু ছাড়; ভোট চুরির ধান্ধা বন্ধ কর, এনআইডির পিছু ছাড়; ভোটার তালিকা ও এনআইডি এক সূত্রে গাঁথা, বিভক্তি মানি না। 

মানববন্ধনে তাদের হাতে বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে কর্মসূচিতে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান, অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব মতিয়ুর রহমান, আশরাফ হোসেন, মো. হাসানুজ্জামান, সাইফুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও নতুন দলের নিবন্ধণ ইস্যুতে উত্তপ্ত মাঠে রাজনীতি

ইসি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার জন্মনিবন্ধন, এনআইডি ও পাসপোর্ট সেবা নিয়ে স্বতন্ত্র একটি কমিশন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এনআইডি সেবা নিজেদের হাতে রাখতে ইতোপূর্বে কর্মসূচি পালন করছেন ইসির কর্মকর্তারা। গত ৫ মার্চ তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি দেন দিয়েছেন। এদিকে ইসির অধীন থাকবে না এনআইডি, দায়িত্ব পাবে স্বাধীন ডেটা অথরিটি (দুই মন্ত্রণালয়ের পরস্পবিরোধী) এমন মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব; যা দুই মন্ত্রণালয়ের সাংঘর্ষিক বক্তব্য। তবে নির্বাচন একটি সাংবিধানিক স্বাধীন কমিশন। জাতীয় পরিচয়পত্র এনআইডির ভার নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের বৈষম্যমূলক বক্তব্যে ও বিরোধের জের সহসায় মিঠছে না বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। 

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ভোটার তালিকা ও এনআইডি একসঙ্গে নির্বাচন কমিশনে রাখার পক্ষে ইসির পূর্বের সংলাপগুলোয় অংশীজনরা মতামত দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে একটি আইন করে শুধু এনআইডি সেবা সুরক্ষা সেবা বিভাগে নেওয়ার চেষ্টা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যমান আইনটি বাতিল করে এনআইডি ইসির অধীনই রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে দেখা যাচ্ছে আলাদা করে একটি কমিশন বানিয়ে এনআইডি তার অধীন নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হল। এনআইডি ইসির অধীন থাকবে এটি যৌক্তিক দাবি। এনআইডি ইসির অধীন না থাকলে নাগরিক সেবা বাধাগ্রস্ত হবে- এমন উদ্বেগ যৌক্তিক। এনআইডি আলাদা হলে নির্বাচন ব্যবস্থাই বাধাগ্রস্ত হবে। এনআইডি এমনভাবে জন্ম হয়েছে এটা কমিশন থেকে আলাদা করার মতো নয়। এটা একটি ডেটাবেইজ। কোনো প্রতিষ্ঠান এনআইডি নিতে হলে ভোটার তালিকাও নিতে হবে। এনআইডি নিলে ভোটার তালিকা ব্যহত হবে। এনআইডি চলে গেলে ভোটার তালিকায় ভাটা পড়বে। এনআইডি জন্ম হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। তাই এখানে থাকা দরকার।

ইসি সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ইসির অবস্থান হচ্ছে এনআইডি কার্যক্রম ইসির অধীন থাকা উচিত। কারণ এটা ২০০৭ সালে গড়ে ওঠেছে ইসির কাছে। ইসির কারিগরি দক্ষতা আছে, এখান থেকে কাম্য সেবা দিচ্ছে ইসি। তিনি বলেন, সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, এতে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ তার নেই। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মতামত দিতে পারবেন। 

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকাররের আমলে নাগরিকদের জন্য ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। তখন এর উপজাত হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ভোটারদের এনআইডি দিয়ে আসছে ইসি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এনআইডি সেবা ইসির কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য ২০২৩ সালে আইনে সংশোধনীও আনা হয়। তবে ওই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে ইসি সচিব উল্লেখ করেছেন, এনআইডি কার্যক্রম স্থানান্তর করলে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে। আবার ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও নির্বাচন আয়োজনে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তাই এ কার্যক্রম ইসির অধীনেই রাখা প্রয়োজন। চিঠিতে ইসি সচিব এনআইডি কর্মকর্তাদের দীর্ঘ ১৭ বছরের অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে ইসি নতুন দলের নিবন্ধন আবেদন আহ্বান করে নির্বাচন কমিশন গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ