আইনে নারী উত্ত্যক্ত বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে যেসব দণ্ডের বিধান আছে
প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৮:৫০ রাত

সম্প্রতি রাজধানীর লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে লাঞ্ছিত করা অথবা মাগুরায় আট বছর বয়সী শিশুকে যৌন নির্যাতনের মতো এরকম আরও অনেক ঘটনায় নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ জোরালো হয়ে উঠেছে।
অথচ বাংলাদেশ নারী নির্যাতন বা হয়রানির বিরুদ্ধে বেশ কিছু আইন রয়েছে।
রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে যাওয়ার সময় একজন নারীকে কেউ উত্ত্যক্ত করলে, কোনো জনসমাগমপূর্ণ স্থানে বা উৎসবে কোনো নারীকে হয়রানি করা হলে আইনের দৃষ্টিতে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি কখনো কখনো সেটা যৌন হয়রানি হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, ইভ টিজিং একটি গুরুতর যৌন নির্যাতন হিসেবেও গণ্য হবে বলে জানান আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণ, ইভ টিজিং (উত্যক্ত করা) বা হয়রানি-এসব অভিযোগে সুনির্দিষ্ট শাস্তি রয়েছে। তবে দেশের আইন শক্ত হলেও সংজ্ঞার ভুল ব্যাখ্যা ও ব্যবহারের কারণে ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়া অনেক সময় দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের দেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় ভুল রয়েছে। প্রেমের প্রলোভন দেখানো- এটাকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় ঢুকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ এফআইআরে যখন লেখা হয় বিয়ের প্রেমের নামে প্রতারণা বা শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছে, এর ফলে যে ক্ষতিটা হয়েছে সেটা হলো ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকেও খর্ব করা হয়েছে।
দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ নারীর শ্লীলতাহানি, যৌন পীড়নের দণ্ড হিসেবে যেমন সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ড রয়েছে, তেমনি দণ্ডবিধি বা পেনাল কোডসহ অন্যান্য বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন মেয়াদী দণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডের শাস্তিও রয়েছে।
যৌন নিপীড়ন, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধের জন্য বাংলাদেশের আইনে কী ধরনের শাস্তি রয়েছে, এই প্রতিবেদনে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
যৌন নিপীড়ন, ইভ টিজিংয়ের শাস্তি: আইনজীবীরা জানান, অপরাধের ধরন ও মাত্রাভেদে বিভিন্ন আইন অনুযায়ী বিচার করা হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি ধারায় যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করে এ অপরাধের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করে বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করে তাহলে এই কাজ যৌন পীড়ন হবে।
এজন্য দায়ী ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর, কিন্তু ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
আইনজীবীরা বলছেন, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে, কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কাজ করে অথবা প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল গান বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে তাহলেও আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে।
দণ্ডবিধির আইনের একটি ধারা অনুযায়ী অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টিকারী ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে বলা হয়েছে।
এই আইনের আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে কথা, অঙ্গভঙ্গি বা কোনো কাজ করে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সাজা বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
তবে আইনের এসব ধারার প্রয়োগ একেবারেই নেই বললেই চলে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন।
নাসরিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইনজীবী হিসেবে আমার ১২ বছরের ক্যারিয়ারে আইনের এই দুই ধারার প্রয়োগ একটা মামলাতেও হতে দেখিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের ওপর দোষ চাপানো হয়।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশেও ইভ টিজিং বা উত্ত্যক্তের বিষয়ে শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
এই অধ্যাদেশের একটি ধারার সংজ্ঞায় নারীকে অপমান বা বিরক্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, 'যদি কেউ কোনো রাস্তায় বা পাবলিক প্লেস থেকে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজের শরীর এমনভাবে প্রদর্শন করে যে কোনো বাড়ি বা ভবনের ভেতর থেকে কোনো নারী দেখতে পায়, অথবা স্বেচ্ছায় কোনো রাস্তায় বা পাবলিক প্লেসে কোনো নারীকে অপমান বা বিরক্ত করে বা তার পথ রোধ করে।'
অথবা 'কোনো রাস্তায় বা পাবলিক প্লেসে কোনো অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোনো নারীকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড দণ্ডিত হবেন, অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন' বলে এই পুলিশ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।
এই অধ্যাদেশের আরেকটি ধারায় সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনানুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তখনই অপরাধ আমলে নিয়ে শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা। এই আইনে সর্বোচ্চ দুই বছর শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে।
কীভাবে পাওয়া যাবে আইনি প্রতিকার: সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী ফওজিয়া করিম মনে করেন, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এটিই মূলত এ ধরনের অপরাধকে প্রভাবিত করে। অপরাধকে ঢাকার জন্য অর্থ ও রাজনীতির ব্যবহারের ফলে মানুষ মনে করতো আমরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাবো।
মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি সংশোধনের জন্য অংশীদারদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই আইনে বেশ কিছু সংশোধনী আনার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানান মিজ করিম।
অভিযুক্ত ব্যক্তি আটক হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করা এবং যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি না ধরা পড়েন সেক্ষেত্রে ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার জন্য সংশোধনী আইনে আনা হতে পারে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
আইনজীবীরা বলছেন, ইভ টিজিং এর শিকার হলে অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিতে হবে। কারণ আইনের আশ্রয় নেয়ার অর্থ হলো এ ঘটনার প্রতিবাদ করা ও আইনিভাবে প্রতিকার চাওয়া।
ফলে ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে প্রথমে নিকটস্থ থানায় গিয়ে দ্রুত বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি লিখিত অভিযোগ করা যাবে। এমনকি পুলিশ নিজে বাদী হয়েও মামলা করতে পারে।
এছাড়া থানায় অভিযোগ না নিলে সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ আছে বলেও জানান আইনজীবীরা।
কেউ ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় বা হচ্ছে, এমন কোনো ঘটনা দেখলে, আশপাশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সঙ্গে সঙ্গে অবহিত করা উচিত।
তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি হাতেনাতে প্রমাণ পায়, তাহলে ঘটনাস্থলেই শাস্তি দিতে পারবে।
তবে এক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিরীহ কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে এর ফল উল্টো হতে পারে বলেও জানান আইনবিদরা।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
ফলে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নারীর প্রতি যে কোনো বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিলে তা সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মনে করেন আইনজীবী মিজ নাসরিন।
সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি অন্য কোনো স্ট্যাটিউটরি আইন করা হয় যেটা দিয়ে এ অপরাধকে পেনাল্টির মধ্যে আনা হবে সেটা করাটা ভালো হবে- বলেন মিজ নাসরিন। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা
দৈনিক সরোবর/এএস