ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

আইন কঠোর হলেও ধর্ষণে শাস্তির নজির কম

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৮:৪৫ রাত  

দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে ২০২০ সালে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন অধ্যাদেশ জারি করা হয়। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে কি না, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ মামলাগুলো বছরের পর ঝুলে থাকার অভিযোগও নতুন করে সামনে এসেছে। কিন্তু আইনে যা আছে, তদন্ত এবং বিচার যেভাবে হয়- এই প্রক্রিয়াগুলোতে গলদ কী আছে বা সমস্যাগুলো কোথায়- এসব প্রশ্ন এখন আলোচনায়।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বাড়ছেই। মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বেড়াতে গিয়ে গত ৬ মার্চ দুপুরে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ মার্চ ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে শিশুটি মারা গেছে।

মাগুরার সেই শিশুটিসহ সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ এবং নারী-কন্যাশিশুদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ এবং ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কর্মসূচিতে হাজারো শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। এসব আন্দোলন, প্রতিবাদ ও ক্ষোভের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার আইনে ত্রুটি নাকি কোনো দুর্বলতা আছে? কী কারণে বাড়ছে ধর্ষণ?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণ বা নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইনটি কঠিন হলেও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বা আইন বাস্তবায়নে তদন্তকারীর ও রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা রয়েছে। ফলে মামলার সর্বশেষ পরিণতি সমঝোতায় গিয়ে ঠেকে। তাতে আসামি জামিন পায় এবং অপরাধের দণ্ড থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ধর্ষণ কেন বাড়ছে, আইনি দুর্বলতা কী- এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে সামাজিক অবক্ষয়ই মূল কারণ। অন্য অনেক কারণও রয়েছে। অসহিষ্ণুতা, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক সুবিচারের অভাবও ধর্ষণ বাড়ার বড় কারণ। একটি ঘটনার চূড়ান্ত বিচার করার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা অপরাধকে উৎসাহিত করে। যথাযথ ও সময়োপযোগী তদন্ত করতে না পারা, সাক্ষীদের আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য না দেওয়া এবং পরবর্তীসময়ে মামলা আপস করাও ধর্ষণ বাড়ার কারণ।

শাস্তির কঠোরতায় বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা: সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ২০২০ সালের পর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলো ঘটে মামলাগুলোর বিচার হয় না এবং শুনানি না করে ঝুলে থাকে। আর মৃত্যুদণ্ড আছে এটি জানার পর ধর্ষণের প্রমাণ মুছে ফেলতে ভুক্তভোগীকে হত্যার প্রবণতা বাড়ে। ধর্ষকের ধারণা, ঘটনা প্রমাণিত হলে তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। তাই কোনো চিহ্ন বা আলামত না রাখতে ধর্ষণের পর ভুক্তভোগীকে হত্যার করা হয়। ফলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডটা শাস্তি হিসেবে আসা উচিত। যেন শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।

নারীদের দুর্বল ভাবা সামাজিক প্রতিরোধহীনতা: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আমাদের সমাজে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরুষের তুলনায় এখনো নারীদের দুর্বল হিসেবে ভাবা হয়। যে কারণে সুযোগসন্ধানী চরিত্রগুলো টার্গেট হিসেবে নারীদের বেছে নেয়। সেটাও ধর্ষণের অন্যতম কারণ। এখন মানুষের মনোভাবটা এমন যেন অপরাধ করলেও কেউ ধরতে পারবে না বা পার পেয়ে যাবে। আর এখন যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকটাই ঢিলেঢালা, তাই তারা মনে করে অপরাধ করলেও তাদের ধরার মতো সেরকম ব্যাপার নেই।

তিনি বলেন, আগে যে রকম একটা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠতো সে রকমও নেই। দু’দিন ধরে দেখছি সারাদেশে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের বিষয়ে প্রতিবাদে নেমেছেন। লাঠি মিছিল, সভা-সমাবেশ এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগও চাচ্ছেন তারা।

‘একটা সোসাইটি কীভাবে চলবে তা নিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি স্টাডি করার ব্যাপার থাকে। কী আচরণ করে মানুষ, কী রেসপেক্ট করে, যেসব জায়গা থেকে বড় রকমের লেকিংস দেখতে পাচ্ছি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সব মিলিয়ে অপরাধী বা সুযোগসন্ধানীরা এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করছে তারা মনে করছে ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে’- বলেন এ আইনজীবী।

অ্যাডভোকেট সালমা আক্তার বলেন, ধর্ষণ, বস্ত্রহরণ, নির্যাতন এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, মোবাইল ফোনে পর্নো ছবির সহজলভ্যতা, মাদকের বিস্তার, ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট আইনের সীমাবদ্ধতা, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচারহীনতা।

ধর্ষণ মামলার বিচারে উল্লেখযোগ্য বিষয়: মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের তথ্যমতে, ধর্ষণের শিকার ৭৫ শতাংশ নারীকে স্থানীয় পুলিশ মেডিকেল টেস্টের নামে অপেক্ষা করতে বাধ্য করে। এফআইআর করতে অস্বীকৃতি এবং নানা রকম নথিপত্র বা প্রশাসনিক ধমক প্রয়োগের মাধ্যমে মেডিকেল টেস্ট বিলম্বিত করে। এর পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরা নানাভাবে ধর্ষণের ঘটনাটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে যায়। ফলে ভিকটিমের বিচার পাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

নারী পুলিশের স্বল্পতা সাক্ষীর অভাবে দুর্বল হয় মামলা:

ধর্ষণ মামলায় শাস্তির হার এত কম কেন, জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, আসল দুর্বলতা হলো পুলিশের৷ একটা মামলা প্রমাণ করতে হলে কোর্টে সাক্ষীকে আনতে হবে ৷ সাক্ষীকে আনার দায়িত্ব পুলিশের, কিন্তু এই কাজটা পুলিশ মোটেই করে না বা চেষ্টা করেও সাক্ষীকে আনতে পারেন না।

তদন্ত প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে মামলা দুর্বল হয় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, এটিকে আমরা অতিরঞ্জিত করছি৷ দুনিয়ার যে কোনো দেশে ধর্ষণ হলে তা প্রমাণ করতে শারীরিক পরীক্ষার প্রয়োজন হয়৷ ডাক্তারি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। আমাদের থানাগুলোতে যদি বেশি সংখ্যক নারী পুলিশ থাকতো, ধর্ষণের শিকার যা যৌন হয়রানির শিকার নারী যদি নারী পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারতো তাহলে এটি খুব কঠিন কাজ হতো না। আর নারী চিকিৎসক দিয়ে ভুক্তভোগীর পরীক্ষা করার বিষয়টি তো উচ্চ আদালত রায়ে বলে দিয়েছেন।

আদালতে অভিজ্ঞতা বর্ণনায় হাসিঠাট্টার আশঙ্কা:

আইনজীবী ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আদালত কক্ষে অসংখ্য মানুষ থাকে। তারা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে থাকে। এর মধ্যেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা মামলাগুলোর শুনানি চলতে থাকে। ধর্ষণের অভিযোগকারী নারী আদালত কক্ষে অসংখ্য মানুষের সামনে ধর্ষণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করেন, বিবাদীপক্ষের উকিলের জেরার উত্তর দিতে গেলে ভিকটিমের আশপাশে নানা রকম হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুরু হয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহীনুজ্জামান বলেন, ভিকটিমের বিগত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার কারণে ৯০ শতাংশ শিশু-নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ভিকটিম মানসিক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন। এমন কি আত্মহননের পথ বেছে নেন। এতে ধর্ষণের অভিযোগ বিচারের বাইরে রয়ে যায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূল প্রেক্ষাপট দমনে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করা জরুরি।

মামলা দুর্বল হতে পারে মেডিকেল রিপোর্ট প্রসিকিউশনে: অ্যাডভোকেট ড. মোহাম্মদ আখতার হামিদ বলেন, নারী-শিশু নির্যাতন, দমন ও ধর্ষণের আইনটি অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষ যদি সবকিছু ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারে তাহলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়। প্রসিকিউশনে জড়িতদের বিরাট দায়িত্ব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নথিপত্রে তথ্য-প্রমাণাদি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না, যে কারণে মামলা দুর্বল হয়ে যায়।

তিনি জানান, আইন অনুযায়ী বিচার করতে গেলে পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের আগে মেডিকেল রিপোর্ট। আমাদের এখানে অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে। সেখানে মেডিকেল রিপোর্টও পরিবর্তন হয়ে যায় টাকার বিনিময়ে। আর মানুষের যদি নৈতিক অবক্ষয় ঘটে তাহলে মেডিকেল রিপোর্ট পরিবর্তন না, আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে। শুধু রাষ্ট্রপক্ষকে অপরাধ প্রমাণ করা নয়, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধও থাকতে হবে।

কঠোর শাস্তির কারণে রায় ঘোষণায় দেরি: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ধর্ষণের মামলা নিয়ে আমরা বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই তো কথা বলি। তারা (বিচারক) নিজেরাও স্বীকার করেন, মৃত্যুদণ্ড হলে অর্থাৎ বিয়ন রিজনেবেল ডাউট কথাটা থাকলে তখনো একটা লোককে ফাঁসির আদেশ দেবো আমাদের হাত-পা কাঁপে। তখন আমরা চিন্তা করি কী করা যায়, তখনই রায় দীর্ঘায়িত হয়। এটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রচুর আলাপ-আলোচনাও হয়েছে।

সাতদিনে মামলা নিষ্পত্তির নজির: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, তৎকালীন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহীমের আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিয়েছিলেন যে, ধর্ষণের মামলা ১৮০ দিনে নিষ্পত্তি করতে হবে। সেটি আইনেও বলা আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এই আদেশের পর আমরা দেখেছি ঢাকায় নারী শিশু নির্যাতন দমন আদালতে সাত দিনে একটি ধর্ষণের মামলায় রায় ঘোষণা হয়েছে। সেটা অবশ্য একটা সুপার ফাস্ট স্পিড। এতটা স্পিড হলে আবার অনেক সময় ইনোসেন্ট ভিকটিমদেরও সাফার করার সুযোগ থাকে। এত তাড়াহুড়োর ব্যাপার নেই। ১৮০ দিন বলা হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে হলে বিচার প্রার্থীরা কিছুটা বিচার পাবে।

এছাড়াও মোংলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় চার্জ গঠনের ৭ কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করে দ্রুততম বিচারের নজির গড়েছিলে বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর একমাত্র আসামি আব্দুল মান্নান সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃ্ত্যু কারাদণ্ডের রায় দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক মোহাম্মদ নূরে আলম। অভিযোগে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের অক্টোবরের গোড়ার দিকে বন্দর শহর মোংলায় ৭ বছর বয়সী একটি শিশুকে বিস্কুটের প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে তারই প্রতিবেশী ৫৩ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান সরদার।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ধর্ষণের বিচার বছরের পর বছর ঝুলতে থাকলে সামাজিক নানা ধরনের পরিস্থিতির তৈরি হতে থাকে। আর ভিকটিমের বিচার চাওয়ার পজিশনও অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। সামাজিক চাপ তৈরি হয়, তার ওপর পরিস্থিতির শিকড় গজাতে শুরু করে। সে হয়তো অন্য একটি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। সেখানে ভিকটিমকে পুরনো ক্ষতটা মনে করিয়ে দেওয়া মানে তাকে মানসিকভাবে ডিমোরালাইজ করা। এ জায়গাগুলো তখন ভিকটিম নিতে চায় না।

জেরা, তদন্ত পরিদর্শনে এখতিয়ার নেই বিচারকের: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ফৌজদারি মামলার বিচার করেন রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্র মামলা করে সাক্ষী আনাসহ যা যা করণীয় সবই করেন। আমাদের কোর্টের জাজরা হচ্ছেন সব রেকর্ডার। আমেরিকান জাস্টিজরা ঘটনাস্থলে যেতে পারেন। তারা চাইলে নিজেরা প্রশ্ন করেন। বিচাকরা জেরা করতে পারেন। আমাদের এখানে বিচারকের জেরার এখতিয়ার নেই। জজদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের এখতিয়ার নেই। ইনভেস্টিগেশনের এখতিয়ার নেই। তারা শুধু উভয়পক্ষের কথাগুলো শোনেন। শুনে প্রবাবিলিটি চিন্তা করেন যে কোনটা আসলে প্রবাবল। কোন এভিডেন্সটা মোর ক্রেডিবল সেটার ওপর বেসিস করে একটা পক্ষ অবলম্বন করে রায় দেন। দুটি মতামতের বাইরে তৃতীয় একটা মতপ্রকাশ করেন বিচারক।

সমঝোতায় পার পায় অপরাধীরা: ধর্ষণ মামলার আসামিরা ছাড় পায় কেন- এমন প্রশ্নে আদালত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ধর্ষণের ঘটনায় আইন অনুযায়ী কোনো আসামি ছাড়া পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, আইনটি খুবই কঠিন। কিন্তু ধর্ষণের মামলার আসামি বা অপরাধীরা পার পাওয়ার একামাত্র কারণ সমঝোতা। মামলা নিয়ে ভিকটিম বা বাদীর সঙ্গে বিবাদীর (আসামিপক্ষের) সমঝোতা হলেই পার পেতে পারে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বিচারে জামিন অথবা খালাস পাওয়ার কারণ একমাত্র সমঝোতা।

তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনের মধ্যে এসব মামলার বিচার শেষ করার বিধান আছে। কিন্তু নানা কারণে তা বছরের পর বছর গড়ালেও শেষ হয় না। দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভিকটিম ও সাক্ষীদের মনোজগতে পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে অনেকেই মামলা না চালিয়ে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মোকাবিলা করতে চান।

মামলার চার্জশিট দিতে হবে দ্রুত: সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ধর্ষণ মামলাগুলোর চার্জশিট দ্রুততম সময়ে হওয়া দরকার। আর অপরাধীদের ধরে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগে সরকারের আন্তরিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে। তারা যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট না। আমরা চাইবো শুধু ধর্ষণ না, নারী নির্যাতনের প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় দ্রুততম সময়ে আসামিকে শনাক্ত করবে এবং যারা ভিকটিম তাদের পাশে দাঁড়বে।

বিচারের আগে লিঙ্গচ্ছেদ করা উচিত: মানবাধিকার কর্মী ও সিনিয়র আইনজীবী জেডআই খান পান্না বলেন, ধর্ষণ বা হত্যার বিচারে শৈথিল্য এসব ঘটনাকে উৎসাহিত করছে। এরা কতগুলো মানুষরূপী অমানুষ। মানুষ না, এরা মানসিকভাবে বিকৃত মানুষরূপী পশু। এরাই এমন জঘন্য ও ন্যক্কারজনক কাজগুলো করছে। এরা শিশুর অঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে-ছিঁড়ে রেপ করেছে। এই যে বিকৃত রুচি, এটি কোন আইনে আটকাবো।

তিনি বলেন, আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না, তারপরও মনে হয় এমন বিকৃত হায়েনাদের বিচারের আগে লিঙ্গচ্ছেদ করা উচিত। যদিও এটি ঠিক না। তারপরও দেশে ধর্ষণের সার্বিক অবস্থায় কখনো কখনো এমনটি মনে হয়। আবার এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও গাফিলতি আছে। এখন সন্ধ্যার পর পুরুষরাই ঘরের বাইরে চলাচলের সাহস পায় না, নারীদের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় আছে। কারও কারও কাছে এটি কোনো অপরাধই না, আমার কাছে এটি জঘন্য অপরাধ।

ধর্ষণ মামলার বিচারে পৃথক আদালত: ধর্ষণ মামলার বিচারের জন্য আলাদা কোর্ট এবং গুরুত্ব সহকারে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ মামলার তদন্ত ৯০ দিনে এবং ১৮০ দিনে বিচার শেষ করার যে বিধান সেটি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ঘটনার ভয়াবহতা এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। দিনক্ষণ বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমাতুল করিম বলেন, আমরা মুক্তি চাই এই অভিশপ্ত পরিস্থিতি থেকে। ধর্ষণের শাস্তি যতই ভয়াবহ হোক না কেন, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে এর সুফল কখনোই পাওয়া যাবে না। আর বিচার টাইম ফ্রেমের মধ্যে না, প্রমাণ পেলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখি বিচারক বসতে পারেন না। কোর্ট নেই, অন্যান্য মামলার চাপ। এসব থেকে বের হয়ে ধর্ষণ মামলার পৃথক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইনি প্রক্রিয়া সুফল বয়ে আনবে কীভাবে: নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার (অতিরিক্ত জেলা জজ) মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে আইনে যে সময়সীমা আছে এটিকে মেনে চলা গেলে এর সুফল ভোগ করবে বিচারপ্রার্থীরা। মানুষ আইনের সুফল পেলে সমাজে সেই বার্তা চলে যাবে। অপরাধীরা তখন নিরুৎসাহিত হবে। সেজন্য নির্দিষ্ট সময়ে তদন্ত ও বিচারকাজ শেষ করতে হবে।

আইনি কোনো দুর্বলতা আছে কি না সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে তিনি জানান, আইনে যেভাবে তদন্ত ও বিচারের কথা বলা আছে সেই সময়সীমা যদি আমরা মেইন্টেন করতে পারি তা হলে বিচার প্রক্রিয়া সঠিক সময়ে হবে। তখন বিচারপ্রার্থীরাও দ্রুত রিলিজ পাবেন। 

দৈনিক সরোবর/এএস