ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়

রাঘববোয়ালদের টাকা দেশে আনতে কঠোর সরকার 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: অক্টোবর ০৫, ২০২৪, ০৮:৪৮ রাত  

বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তাছাড়া পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং অর্থপাচার রোধে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) প্রায় ৫০ হাজার হিসাব স্থগিত করেছে সরকার। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি এত ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল যে, সাধারণ মানুষের কাছে এখন এটি আর অজানা নেই। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, কেবল আওয়ামী সরকারের কাছেই জানা ছিল না ব্যাপারটা। কিন্তু এবার বিগত সময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা রাঘববোয়াল ও অর্থপাচারকারীদের টাকা দেশে ফেরাতে কঠোর তৎপরতা চালাচ্ছে নতুন সরকার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক কমিশনার ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টাকা পাচারের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এটিই বাধা ছিল। এর সঙ্গে দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তবে পাচারের টাকা ফেরানোর এখনই উপযুক্ত সময়।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, বিদেশে টাকা পাচারকারী হিসেবে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে, যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে ওইসব দেশের কনভেনশন অনুযায়ী অনুরোধ করতে হবে। তাদের অর্থের পরিমাণ, সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের এজেন্সির মাধ্যমে মামলাগুলো পরিচালনা করবে। রায় নিয়ে তা পাচার হওয়া দেশে পাঠানোর পর তারা তাদের যে কনভেনশন আছে তার আলোকে পাচার হওয়া অর্থ পাঠাবে বাংলাদেশে।

জানা গেছে, গত দেড় দশকে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বড় গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য, দুবাই,  সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্র। মূলত স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসনের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়ে এ দেশের টাকা খুব সহজেই পাচার হয়েছে ভিন দেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর এই পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে। তবে এবার যেসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে; তা দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গত ৯ বছর আগে গঠন করা ১০ সদস্য বিশিষ্ট টাস্কফোর্সকে ১৪ সদস্যে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন এই টাস্কফোর্স পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে নতুন করে কাজ শুরু করেছে। পুনর্গঠন হওয়া কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে থাকছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল।

পাচারের ৮০ শতাংশই হয়েছে পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে

বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবছর পাচার করা হয়েছে অন্তত একলাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশটিতে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা করা আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ এবং ২০২৩ সাল শেষে এটি নেমে এসেছে এক কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁয়। তথ্য-উপাত্ত থেকে আরও জানা যায়, পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের মুদ্রা পাচার করা হয়। কখনো আন্ডার ইনভয়েস, কখনোবা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই পাচার হয়ে থাকে। প্রবাসীদের বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমেও একটি বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। দেশের গুটিকয় অসাধু শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরাও এই পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস, বন্দরসহ অনেক সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকার প্রমাণ রয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অর্থপাচার ঠেকাতে কাজ করছে ৭ সংস্থা। সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিদ্যমান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের মানিলন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধের তদন্তভার সিআইডি, এনবিআরসহ অন্য সংস্থাগুলোর কাছে ন্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরা একযোগে কাজ করলেই পাচার কমে যাবে।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন জানান, এফবিআই প্রতিনিধিদল দুদকের মানিলন্ডারিং অ্যান্ড লিগ্যাল শাখার মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বৈঠক করেছেন। প্রাথমিকভাবে এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল। আমরা একে অপরের কাজের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে বৈঠকে মানিলন্ডারিংরোধে করণীয়, কারিগরি সহায়তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের টাকা ফেরাতে টাস্কফোর্স কীভাবে এফবিআইকে পাশে পাবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যৌথ টাস্কফোর্সে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকবে নাকি পরামর্শক হিসেবে থাকবে তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া এফবিআইয়ের সঙ্গে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করারও চিন্তাভাবনা রয়েছে দুদকের।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আগে অর্থ পাচারের জায়গাগুলোকে ট্র্যাকিং করতে হবে। সেটা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, পাশাপাশি যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেসব দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। প্রয়োজনে চুক্তি করতে হবে। তবেই অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবে চতুর্মুখী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে সেটা খুবই ভালো দিক। কারণ এতে করে যারা বিদেশে টাকা পাচার করার চিন্তা করেন তারা অন্তত ভয় পাবেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে তাদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা দুটোই প্রকাশ পেয়েছে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ