জীবিকা: খুলনার শিল্পাঞ্চলে সেই কোলাহল এখন আর নেই
প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৪:০৮ দুপুর

খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুর এলাকাটি এক সময় ‘শিল্পাঞ্চল জোন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অনেকগুলো পাটকল চালু থাকায় দিনরাত কোলাহলে মুখর থাকতো এই অঞ্চল। এখন সেই কোলাহল আর নেই।
সবগুলো পাটকল বন্ধ হওয়ায় জীবিকার তাগিদে এ অঞ্চল ছেড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পাড়ি দিয়েছেন অন্য শহরে। বর্তমানে কিছু পাটকল চালু থাকলেও থেকে যাওয়া অনেক শ্রমিক এখন ইজিবাইক, রিকশা চালিয়ে দিনাতিপাত করছেন। অনেকে শুরু করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্য।
স্থানীয়রা জানান, পাটকল ঘিরে একটা সময় হাজার হাজার মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলে। তিন শিফটে কাজ করতো হাজার হাজার শ্রমিক। শিফট বদলের সময় মানুষের কোলাহলে মুখরিত থাকতো কারখানা এলাকায়। শ্রমিকরা বের হয়ে কেউ কেউ চায়ের দোকানে ভিড় জমাতেন। আবার অনেকে ছুটে যেতেন বাজার করতে। এভাবে জমজমাট ছিল খালিশপুর-দৌলতপুর অঞ্চল। অসংখ্য সবজি বাজার, রেস্তোরাঁ, মুদিদোকান, কাপড়ের ব্যবসা, ওষুধের ব্যবসা গড়ে ওঠে এ অঞ্চল ঘিরে। কিন্তু পাটকল বন্ধ হওয়ায় জমজমাট খালিশপুর-দৌলতপুর এলাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা।
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্রে জানা যায়, খুলনায় অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত আলিম জুট মিল, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, প্লাটিনাম, স্টার, দৌলতপুর ও খালিশপুর জুট মিল ২০২০ সালের ২ জুলাই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এসব জুট মিলে প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রিসেন্ট জুট মিলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৮০০-১০ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। প্লাটিনাম জুট মিলে প্রায় সাত হাজার, খালিশপুর জুট মিলে প্রায় ছয় হাজার শ্রমিকসহ অন্যান্য জুট মিলে গড়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন এখানে। প্রতিদিন তিন শিফটে জুট মিলে দিনরাত কাজ চলতো। সাতটি জুট মিল থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ টন সুতা উৎপাদন হতো।
সূত্র আরও জানায়, সরকারিভাবে পাটকল চালু না করলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারার মাধ্যমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে সীমিত পরিসরে দৌলতপুর জুট মিলে উৎপাদন শুরু করে ফরচুন গ্রুপ। আর ইস্টার্ন জুট মিল ইজারা নিয়ে উৎপাদন শুরু করে ভারতীয় কোম্পানি আটলান্টিস জুট লিমিটেড। দুটি কারখানায় বর্তমানে ২৫০-৩০০ শ্রমিক কাজ করছেন। মিল দুটি থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩-৪ টন পাট প্রক্রিয়াজতকরণ করা হয়।
বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের বদলি শ্রমিক নাসিমা বেগম বলেন, জুটমিলে কাজের খবর পেয়ে প্রায় ১২ বছর আগে বরিশাল থেকে খুলনায় পরিবারসহ আসি। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল। সন্তানদের এখানকার স্কুলে ভর্তি করি। কিন্তু ২০২০ সালে পাটকল বন্ধ হওয়ায় সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। এখন অভাব-অনটনে দিন কাটছে। করোনার সময় অনেক সমস্যার মধ্যে চলতে হয়েছে। বর্তমানে ছুটা কাজ করে দিন চলছে।
আরেক শ্রমিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্লাটিনাম জুট মিলে অবসায়নের (কোম্পানির বিলোপসাধন) পর পাওনা ছিল আট লাখ ২১ হাজার টাকা। এর মধ্যে চার লাখ টাকা নগদ ও বাকি টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছে। বর্তমানে ইজিবাইক চালিয়ে আমার দিন কাটছে। অন্য কোনো কাজ করার অবস্থা নেই।
পাটকলের শ্রমিক আবদুর রাজ্জাক বলেন, মিল বন্ধের পর ইজিবাইক চালানো শুরু করি। আমার এখানে জন্ম, এখানেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে। এখানেই বিয়ে করেছি। এখন ছেলে অনার্সে লেখাপড়া করছে। স্মৃতিবিজড়িত এ জায়গা ছেড়ে যেতে চাই না বলে পরিবার নিয়ে থেকে গেছি।
কথা হয় ইস্টার্ন জুট মিলের শ্রমিক পারুল আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার স্বামী ফুল টাইম এবং আমি বদলি শ্রমিক হিসেবে পাটকলে কাজ করতাম। পিরোজপুর থেকে এসে ২০০৯ সাল থেকে এখানে কাজ শুরু করি। পাটকল বন্ধ হলে গচ্ছিত টাকায় আমার স্বামী রিকশা কেনেন। দেশের বাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা নেই বলে খুলনায় রয়ে গেছি।
তিনি আরো বলেন, আমার সঙ্গে কাজ করতেন এমন অনেকে করোনার সময় অভাব-অনটনে খুলনা ছেড়েছেন। অনেক নারী শ্রমিক ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজের সন্ধানে চলে গেছেন।
আমিনুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, পাটকল বন্ধ হওয়ার পর পাওনা টাকা দিয়ে মুদিব্যবসা শুরু করেছি। অনেকবার শুনেছি পাটকল চালু হবে। গত বছর বেসরকারিভাবে দু‘টি কারখানা চালু হলেও মানুষের মধ্যে এখন আর আশার সঞ্চার হচ্ছে না। নতুন করে কেউ আর কাজের আশা নিয়ে হয়তো আসবে না।
আলমনগরের স্থানীয় বাসিন্দা জবেদ আলী জানান, বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পাটকলে কাজের তাগিদে বরিশাল অঞ্চলের মানুষ বেশি এসেছেন। তাদের অনেকে মুদি ব্যবসা, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, ওষুধের ব্যবসা, কাঁচাবাজারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু পাটকল বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা নিজ নিজ দেশের বাড়ি এবং অন্য শহরে চলে যাওয়ায় আগের মতো কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নেই এ অঞ্চলে।
ক্রিসেন্ট মোড়ের বাসিন্দা খায়রুল হক। তিনি বলেন, একটা সময় পাটকলগুলোকে ঘিরে খালিশপুরে লোকালয় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাটকল বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে খুলনা ছেড়েছেন। অনেকে করোনাকালীন চলে গেছেন নিজ এলাকায়। যারা জমি জায়গা কিনতে পেরেছেন তারা থেকে গেছেন। বাকিরা দিনের পালা বদলে ছেড়েছেন এ শিল্প এলাকা।
তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলে জমি-জায়গা অনেক বেচাকেনা হয়েছে। পাটকল বন্ধ হওয়ায় অনেকেই জমি বিক্রি করে অন্য এলাকায় ব্যবসা শুরু করে বসবাস করছেন। নতুন বাসিন্দার আগমন ঘটলেও এ এলাকার নীরবতা এখনো কাটেনি।
এ বিষয়ে বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা গোলাম রাব্বানী বলেন, বর্তমানে লিজে ইস্টার্ন ও দৌলতপুর জুট মিলসে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাটপণ্য উৎপাদন শুরু করেছে। তারা খুব বেশি উৎপাদন না করলেও মিলগুলোকে উৎপাদনমুখী রেখেছেন। অন্যান্য মিল চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বেসরকারিভাবে চালু হওয়া মিলগুলো দ্রুত লাভের মুখ দেখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি জানান, ২০২০ সালে পাটকল বন্ধ ঘোষণার পর ২০২২ সালে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়।
দৈনিক সরোবর/এএস