ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

জামিন পেলেন এলজিইডির সেই নির্বাহী প্রকৌশলী

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

 প্রকাশিত: মার্চ ১৪, ২০২৫, ০৭:৩৪ বিকাল  

গাইবান্ধার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাবিউল ইসলামকে শর্ত সাপেক্ষে মুচলেকা নিয়ে জামিন দিয়ে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা আদালত তলব করা মাত্র, তাকে যথাসময়ে হাজির হতে হবে-এমন মুচলেকা দেন তিনি।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে আবেদনসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাঠানো হচ্ছে। তারাই তদন্ত সাপেক্ষে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।  

নাটোরের সিংড়ায় জব্দ একটি প্রাইভেটকার ও ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকাসহ থানা হেফাজতে ছিলেন তিনি।

শুক্রবার দুপুরে সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসমাউল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, জব্দ একটি প্রাইভেটকার ও নগদ ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা থানা হেফাজতে রাখা আছে। দুদক অথবা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাওয়া মাত্র আইনি প্রক্রিয়ায় তা দেওয়া হবে।  

বৃহস্পতিবার  রাত ২টার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের চলনবিল গেট এলাকায় পুলিশের নিয়মিত চেকপোস্টে তল্লাশির সময় একটি প্রাইভেটকার থেকে গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী পরিচয়দানকারী মো. সাবিউল ইসলামের কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা জব্দ করে পুলিশ। একই সঙ্গে গাড়িটি জব্দ করে ওই প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নেওয়া হয়।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে মহাসড়কের চলনবিল গেট এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছিল পুলিশ। সেসময় গাইবান্ধা থেকে রাজশাহীগামী একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকারকে থামার সিগন্যাল দেওয়া হয়। গাড়িটি থামার পর তল্লাশি করে ওই টাকাগুলো পাওয়া যায়। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. একরামুল হক, সিংড়ার ইউএনও মাজাহারুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ সুপার (সিংড়া) সার্কেল সনজয় কুমার সরকার, নাটোর সদর থানার ওসি মাহাবুর রহমান, সিংড়া থানার ওসি মো. আসমাউল হক ও পুলিশের যৌথ টিম এবং সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে যায়।

এ ব্যাপারে এলজিইডির প্রকৌশলী পরিচয়দানকারী সাবিউল ইসলাম বলেন, জমি বিক্রির বৈধ টাকা নিয়ে গাইবান্ধা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলাম।  

তবে তার (সাবিউল ইসলাম) বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে দুদকে মামলা হয়েছে কিনা এবং দীর্ঘদিন একই এলাকায় কর্মরত থাকায় চাকরির বিধি লঙ্ঘন করেছেন কিনা তা জানতে চাইলে তিনি এসব বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বরং এ নিয়ে সংবাদ না করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

থানা হেফাজতে নেওয়া মো. সাবিউল ইসলাম রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি বর্তমানে গাইবান্ধায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার আদি বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায় বলে জানা গেছে।

সিংড়া থানার ওসি আসমাউল হক এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে টাকার উৎসের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ দেখাতে পারেননি মো. সাবিউল ইসলাম। তবে তিনি গাইবান্ধার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরে তাকে শর্ত সাপেক্ষে মুচলেকা নিয়ে জামিন দেওয়া হয়েছে। তবে যখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুদক কিংবা আদালত তাকে তলব করবেন, তখনই তাকে যথা সময়ে হাজির হতে হবে -এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে।

ওসি বলেন, এলজিইডির প্রকৌশলী পরিচয়দানকারী সাবিউল ইসলাম পুলিশকে প্রথম দিকে জানিয়েছিলেন যে, তার কাছে জমি বিক্রির ৩০ লাখ টাকা আছে। পরে গুনে আরো ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এসব টাকা আদৌ জমি কেনাবেচার বৈধ টাকা, নাকি ঘুষের টাকা তা খতিয়ে দেখবে দুদক। তাই তার বিরুদ্ধে তদন্ত করাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে আবেদনসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাঠানো হচ্ছে। তারাই তদন্ত সাপেক্ষে এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন। তাছাড়া এখনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।

এদিকে দুদক আইন ও বিধি অনুযায়ী জানা যায়, জব্দকৃত টাকা ও প্রাইভেটকার জিডি মূলে আদালতে এবং অভিযুক্তকে কারাগারে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি দুই কার্যদিবসের মধ্যে জিডিসহ সব নথিপত্র দুদকে পাঠানোর বিধান রয়েছে। সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, তা এখন দেখার বিষয়।

অন্যদিকে গাইবান্ধার এলজিইডি একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ১৬ বছর ধরে ঘুরে ফিরে গাইবান্ধা জেলায় চাকরি করছেন নিবার্হী প্রকৌশলী সাবিউল ইসলাম। ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর মাসে উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় যোগদান করেন তিনি। সেখানে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন কর্মরত ছিলেন।

এরপর জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধা জেলা এলজিইডি কার্যালয়ে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন। সেখানে তিনি ১ বছর ৬ মাস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সাবিউল ইসলাম নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে গত ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলায় যোগ দেন। সেখানে মাত্র ২৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তদবির করে গত একই বছরের ৬ অক্টোবর গাইবান্ধায় বদলি নেন তিনি।

পরদিন ৭ অক্টোবর তিনি গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ৮ নভেম্বর তিনি পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে দায়িত্বও বুঝে নেন। সাঘাটায় যোগ দেওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে (১৬ বছর ৩ মাস ১২ দিন) তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত আছেন। চাকরিবিধি উপেক্ষা করে টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে এক জেলাতেই ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

গত ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা দায়ের করেছিলেন রাশেদ খান মেনন নামে এক ঠিকাদার। অবশ্য এ মামলায় আরো দুজনকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই মামলার আর অগ্রগতি হয়নি বলে ওই সূত্রটি দাবি করে।

কারণ তিনি সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার খুব আস্থাভাজন ছিলেন। তাই বার বার এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে দীর্ঘদিন তাকে সাঘাটায় রেখেছিলেন। এখনও বহাল তবিয়তে গাইবান্ধা জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।  

এর আগে তিনি একটানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন সাঘাটা উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি পার্শ্ববর্তী ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবেও মাঝে মাঝে অতিরিক্ত (ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলীর বদলিজনিত কারণে) দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বকালীন সময় ফুলছড়ি উপজেলার অসংখ্য জরাজীর্ণ সেতু ও কালভার্ট নিলামে বিক্রয় হয়। তিনি বিক্রয়কৃত প্রায় পৌনে ৩ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করে অফিস সহায়ক মিলন হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন।

দৈনিক সরোবর/এএস