ঘুষের টাকা ফেরত পেতে শিক্ষিকার লাশ নিয়ে বিদ্যালয়ে স্বজনেরা
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৪, ০৭:০৮ বিকাল

২০ বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও পাননি বেতন। বেতন পেতে দফায় দফায় পরিচালনা কমিটিকে দিয়ে গেছেন ঘুষ। তবে বেতন পাওয়ার আগেই পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন রোকেয়া খাতুন নামের এক শিক্ষিকা। এবার ঘুষের টাকা ফেরতের দাবিতে ঔ শিক্ষিকার মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন স্বজনেরা। এ সময় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক গিয়ে উত্তেজিত জনতার সামনে আগামী তিন দিনের মধ্যে গৃহীত ওই ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ঙ্গীকার করেন। পরে স্বজনেরা লাশ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে দাফনের ব্যবস্থা করেন।
সোমবার এ ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গাড়াবেড় গ্রামে। টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি ওই শিক্ষিকা তার বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন বলে দাবি জানিয়েছেন স্বজনেরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মৃত রোকেয়া খাতুন উপজেলার জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শাখার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। ২০ বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও বেতন পাননি তিনি। বরং বেতন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয়রা বলছে, রোকেয়া খাতুন বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভূতবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। গাড়াবেড় গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে নিয়মিত পাঠদান করিয়েছেন তিনি। কিন্তু বেতন করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় ঘুষ নিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু।
বিদ্যালয়ের অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। পরে ২০০৪ সালের ৩ আগস্ট দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই বছরের অক্টোবরের ২৩ তারিখে নিয়োগ পরীক্ষার পর ৬ নভেম্বর বিদ্যালয়টিতে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রোকেয়া খাতুন। এরপর থেকে অদ্যাবধি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে নিয়মিত পাঠদান করাতেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঘুষের সেই টাকা ফেরতের দাবিতে সোমবার সকালে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় চত্বরে অবস্থান নেন ওই শিক্ষিকার স্বজনেরা। চার লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করলে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তারা। টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি ওই শিক্ষিকা গাড়াবেড়ের বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন। পরে সোমবার ভোররাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন।
রোকেয়া খাতুনের স্বামী আব্দুল করিম বলেন, আমি নিজেও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলাম। তখন বিদ্যালয়ের ঘর করার কথা বলে আমার স্ত্রী ও আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেয় প্রধান শিক্ষক ফরিদুল। এরপর আমি সেখান থেকে সরে আসলেও আমার স্ত্রী থেকে যায়। বেতন করে দেওয়ার কথা বলে পরে দফায় দফায় চার লাখ টাকার মত নেয় তারা। কিন্তু বেতন করে দেয়নি।
তিনি বলেন, সর্বশেষ বেতন করে দেওয়ার কথা বলে ২০২২ সালে দুই লাখ টাকা চায়। সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে দেড় লাখ টাকায় মীমাংসা হয়। পরে আমি দেড় লাখ টাকা দিয়ে সভাপতি বাবলু চেয়ারম্যানের পায়ে পড়ি, স্ত্রীর বেতন করে দেওয়ার জন্য। সেই টাকাও বিফলে যায়। সব মিলিয়ে আমার কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকার মতো নিয়েছে তারা। টাকার শোকে আমার স্ত্রী স্ট্রোক করে মারাই গেল। আমি ওই টাকা ফেরত চাই। সাথে এই দীর্ঘদিন যে পরিশ্রম করেছে তার ক্ষতিপূরণ চাই।
রোকেয়ার বড় ভাই খলিলুর রহমান বলেন, আমার বোনের বেতন করে দেওয়ার কথা বলে প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম ও সভাপতি, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু পর্যায়ক্রমে সাত থেকে আট লাখ টাকা নিয়েছে, কিন্তু বেতন করে দেয় নাই। টাকার শোকে আমার বোন স্ট্রোক করে মারা গেছে। আমরা এর ন্যায় বিচার চাই।
রোকেয়ার ভাগনে হাশেম আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, এমপিওভুক্তির আবেদনের কথা বলে খরচ বাবদ আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেয় বিদ্যালয়টির করণিক লোকমান হোসেন। এর বাইরেও সম্মানীর টাকা চান লোকমান হোসেন।
করণিক লোকমান হোসেন টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি ওই টাকা নিয়ে হেড স্যারকে দিয়েছি। হেড স্যারের বাইরে তো আর আমি কিছু করতে পারব না।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলামও টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রোকেয়ার টাকা দিয়েই আমরা বিদ্যালয়ের ঘর ওঠাই। বেতন করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় টাকাও নিয়েছি। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা রোকেয়ার ৪ লাখ টাকা ফেরত দেব।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলুও ঘুষের টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বেতন করে দেওয়ার কথা বলে আমরা যে টাকা নিয়েছি তার ৪ লাখ টাকা রোকেয়ার স্বজনদের কাছে ফেরত দেব। ইউএনও স্যার এসে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিক্ষিকার লাশ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থানের খবরে ঘটনাস্থলে যাই। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সভাপতির সাথে কথা বলি। তাঁরাও টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলেছে আগামী তিন দিনের মধ্যে চার লাখ টাকা ফেরত দেবেন।
দৈনিক সরোবর/এএস