ঢাকা, সোমবার, ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১ ভাদ্র ১৪৩১

এমপি আজিমের মরদেহ না পেলে তৈরি হতে পারে জটিলতা 

সরোবর প্রতিবেদক 

 প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৪, ০৫:৫৭ বিকাল  

কলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মরদেহের সন্ধান পেতে ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। গতকাল নিউটাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনের সেপটিক ট্যাংকের বর্জ্য ঘেঁটে অনেকগুলো মাংসের টুকরো উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। সঙ্গে মিলেছে কিছু চুল, চামড়া এবং হাড়ও। তবে সেগুলো এমপি আনারের কি না তা এখনো নিশ্চিত করা বলতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফরেনসিক পরীক্ষার পরই কেবল তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এটা নিশ্চিত হওয়া গেলেও কেন তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া এতো জরুরি? কেনইবা মরদেহ বা দেহের যেকোনো খণ্ডিত অংশের জন্য দুই দেশেরই তদন্ত কর্মকর্তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে?

আনোয়ারুল আজিম সংসদ সদস্য হওয়ায় তার মরদেহ না পেলে বেশ কিছু আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। মামলা প্রমাণ করা, সংসদ সদস্য পদ এবং পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মরদেহ না পেলে হত্যা মামলা প্রমাণ কি সম্ভব?

এমপি আনার নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশের পর ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চারজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে। একইসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাদের জেরার মুখে আসামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আনারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিশ্চিত করছে তারা। দুই দেশেই হয়েছে দুটি মামলা।

তবে মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করলেও এখনও পাওয়া যায়নি আনারের মরদেহ। ফলে হত্যা মামলা প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরদেহ পাওয়া না গেলেও মামলা প্রমাণ করা সম্ভব। তবে সেটি বেশ কঠিন।

এক্ষেত্রে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব যেহেতু রাষ্ট্র পক্ষের থাকে, তাই যে কয়েকটি বিষয় মামলা প্রমাণে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোতে বেশি গুরুত্বারোপ করতে হয়।

ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, হত্যা মামলায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মরদেহ না পেলে এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হত্যা মামলাকে প্রমাণ করা যায়। একইসঙ্গে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণও মামলাটি প্রমাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরদেহ না পেলেও হত্যা মামলা প্রমাণের অনেক নজির দেশে ও বিদেশে রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও এ ধরনের মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনাও রয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থাকলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণে মামলা প্রমাণ করা যাবে। তবে যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না থাকে তবে মামলা প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়বে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা যেসব ক্লুর ভিত্তিতে খুনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সেসবসহ আসামিদের জবানবন্দি রয়েছে। ব্লাডস্টেইন, চুল এসবের ভিত্তিতে ডিএনএ টেস্টে তারা প্রমাণ করতে পারবে।

তাপস কান্তি বল বলেন, বাংলাদেশেই এরশাদ শাসনামলের সময়ে একটি হত্যা মামলায় মরদেহ পাওয়া না গেলেও মামলা প্রমাণের পর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করা গিয়েছিল।

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন তিনি। ঝিনাইদহ -৪ আসনে সে সময় থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন তিনি।

সংবিধানে সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়ার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে সেই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে গেজেট প্রকাশ করে সংসদ সচিবালয় তা নির্বাচন কমিশনকে জানায়। নির্বাচন কমিশনের ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।

সাধারণত কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর দ্রুতই সেই আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। সংসদ সদস্য মারা গেলে স্পিকার শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এছাড়া অধিবেশন চলাকালে কেউ মারা গেলে ওই দিনের জন্য সংসদ অধিবেশন মুলতবি করার রেওয়াজও রয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু বলেন, যেদিন থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত হবে, সেদিন থেকে সংবিধান এবং কার্যপ্রণালী অনুযায়ী ওই আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। অন্যান্য সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করলে যেটা হয় সেটাই হবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। অপরাধের তদন্ত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তারা যদি মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত নয় জানায় এরপর অনুপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনা করে সংসদ সদস্য পদ খারিজ করতে পারবে।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এমপি আনারের পেশা হিসেবে ব্যবসা ও কৃষিকে উল্লেখ করেছেন। একইসঙ্গে হলফনামায় নিজের একটি গাড়ি এবং স্ত্রীর চারটি ট্রাকের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি এমপি আনার। যদিও হলফনামায় নিজের বা পরিবারের কারও বাসের মালিকানার তথ্য উল্লেখ করেননি। আনার এবং তার স্ত্রীর এক কোটি ৬০ লাখ নগদ টাকা রয়েছে বলে হলফনামায় তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে।

এমপি আনারের ৩৩ বিঘা কৃষি জমি রয়েছে। স্ত্রীর সাড়ে ২৪ শতাংশ কৃষি জমি আছে বলে হলফনামায় তথ্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিজের অকৃষি জমি ১২৯ শতাংশ এবং স্ত্রীর ১৭৯ শতাংশ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

এসব অকৃষি জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৮২ লাখ টাকার বেশি। এছাড়াও কালীগঞ্জ পৌর এলাকায় তার একটি চারতলা বাড়ির কথা হলফনামায় বলা হয়েছে।

কৃষি থেকে বছরে দুই লাখ টাকার মতো আয় করেন সংসদ সদস্য আনার। বছরে প্রায় ৩৮ লাখ টাকা ব্যবসা থেকে আয় করেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন ও ভাতা পান বছরে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। ফলে আইনগতভাবে মৃত্যু নিশ্চিত না হলে এসব স্থাবর–অস্থাবর সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনে বলা হয়েছে, সাত বছর কোনো ব্যক্তির কারও সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে বা নিখোঁজ থাকলে তাকে মৃত বলে বিবেচনা করা হবে।

আর ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, ব্যাংকে থাকা অর্থের উত্তরাধিকার হবেন নমিনি। মারা গেলে ডেথ সার্টিফিকেট, সাকসেশন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে তা প্রমাণ করার পরই তাকে তা দেওয়া হবে।

তবে একটি মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে, নমিনি অর্থ তুলতে পারলেও তা ভাগ বা বণ্টন হবে ইসলামি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারদের মধ্যে।

সাবেক ব্যাংকার নুরুল আমিন বলেন, আনোয়ারুল আজিমের ঘটনা অতি পরিচিত ও আলোচিত হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো বিবেচনা করবে। কারণ তদন্তের বিষয়ে তারা জানতে পারছে। ফলে এতে তার পরিবারকে আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারকে অর্থ দিতে ব্যাংকের আপত্তি থাকার কথা নয়। সাকসেশন সার্টিফিকেট দিতে হবে তাদের। এটা দিলে তিনি মারা গেছেন এটা ব্যাংকের প্রমাণ করতে হবে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএল