ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

বন্ধ হয়নি, ভিন্ন নামে চলছে দখল ও চাঁদাবাজি

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৪, ০৭:৩৭ বিকাল  

রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে সাভারের হেমায়েতপুর। মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরে জয়না বাড়ি রোড। এখানকারই স্থানীয় এক বাজারে গিয়ে চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেলো। দোকানিরা জানাচ্ছেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন চাঁদা তুললেও এখন এর নিয়ন্ত্রণ ‘অন্য গ্রুপের’ হাতে।প্রতিদিন দোকানপ্রতি তোলা হচ্ছে দুইশত টাকা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলছিলেন, আওয়ামী লীগ এখন নাই। কিন্তু এরপরও দুইদিন চাঁদা দিলাম। আইসা কয় টাকা মাফ নাই। হ্যারা নাকি এখন টাকা তুইল্যা অন্য গ্রুপের কাছে দিতাছে।

অন্য গ্রুপ মানে কী এমন প্রশ্নে অবশ্য খোলাসা করে কিছু বলেননি তিনি। তবে তিনি বলেন, আগে যে ম্যানেজার কালেকশন করতো, সে ছিল আওয়ামী লীগের ম্যানেজার। ঐ ম্যানেজারই কালেকশন করতাছে। এখন টাকা নিয়া সে কারে দেয়, সেই প্রশ্ন আর করি নাই। আরেকজন দোকানি জানালেন, আগের মতোই তিনি দুইশত টাকা করে চাঁদা দিচ্ছেন। তিনি বলেন,আমি একদিন দিছি দুইশত টাকা। পরের দিন দোকান খুলি নাই, টাকাও দেই নাই। আজকে খুলছি, এখন টাকা দেয়া লাগবে।

বাংলাদেশে কোনো একটি সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা দখলের যে পুরনো ব্যবস্থা, সেটার পরিবর্তন খুব একটা হয় না। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কমবেশি একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, প্রভাব খাটানো এমনকি দখলের মতো অভিযোগ উঠছে বিশেষত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যদিও অন্তবর্তীকালীন সরকার তো বটেই খোদ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনায় কোনো ছাড় না দেয়ার কথা। কিন্তু এতে করে কি চাঁদাবাজি আর দখল বন্ধ হয়েছে? বাস্তবতা অবশ্য সেটা বলছে না।

বিএনপির সাইনবোর্ডে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ: সাভারের হেমায়েতপুরে সব স্থানে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে এমন নয়। বিশেষত মূল সড়ক এবং সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ড, টেম্পু স্ট্যান্ড এবং দোকানগুলোতে কেউ চাঁদা চাইতে আসছে না বলেই জানাচ্ছেন দোকানদাররা।

ইমরান আলী নামে একজন পোশাকের দোকানি বলছেন, আগে চাঁদাবাজি হলেও এখন আর কেউ আসছে না।এখনতো সবখানে ছাত্র। সবাই বলে গেছে, কেউ চাঁদা নিতে আসলে ফোন করে জানাইতে। এছাড়া মাইকিংও হইছে। ফলে এখনও পর্যন্ত আমরা শান্তিতে আছি। তবে হেমায়েতপুরের একটু ভেতরে গেলে চাঁদাবাজির চিত্র স্পষ্ট হয়। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, জয়নাবাড়ি, যাদুরচর, শ্যামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির ঘটনা চলছে। কিন্তু কারা করছে এসব এমন প্রশ্নে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি হলেন না। তবে গোপনীয়তা রক্ষার শর্তে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এসব চাঁদার পেছনে আছে তাদের ভাষায় ‘বিএনপির লোকজন’।

রমিজ উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন দোকান, রিক্সা স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা তুলতো। মূলত. সরকারি জায়গায় যেসব দোকান আছে সেগুলো থেকে ভাড়ার নামে চাঁদা তোলা হয়। এগুলো সব আওয়ামী লীগের ব্যানারে হয়েছে। পট পরিবর্তনের পরে এখন বিএনপির সাইনবোর্ড লাগায়ে ঐ গ্রুপটাই আবার শুরু করছে। তাদের পেছনে আছে বিএনপির লোকজন। আওয়ামী লীগের অফিস এখন বিএনপির দখলে: ঢাকার বাইরে যেমন দখল, চাঁদাবাজির চিত্র আছে তেমনই একই অভিযোগ আছে ঢাকার ভেতরেও।

বুধবার ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে গিয়ে দেখা গেলো দখলের দৃশ্য। বাবর রোডে বিহারি ক্যাম্পের কাছেই রাস্তা এবং ফুটপাতের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিলো শ্রমিক লীগের একটি কার্যালয়।ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সেই কার্যালয়ের দখল নিয়েছে মোহাম্মদপুর থানা যুবদল। সরেজমিনে দেখা গেলো, কার্যালয়টি তালাবদ্ধ। কিন্তু জাতীয়তাবাদী যুবদলের একটি ব্যানার ঝুলছে। খোঁজ নিতেই জানা গেলো, যুবদলের নেতা-কর্মীরা কার্যালয় দখল করলেও সেখানে আপাতত কেউ বসছে না।

স্থানীয় একজন বাসিন্দা জানালেন, দখলের পর এখানে কাউকে বসতে দেখিনি। শেখ হাসিনা পালাইবার পরে এখানে এখন বিএনপি দখল করছে। কিন্তু ওরা শুধু ব্যানার লাগাইছে, বসে না। যখন ক্ষমতায় আসবে তখন বসবে। একই অবস্থা পশ্চিম আগারগাঁও এলাকাতেও। সেখানে কালভার্টের উপর গড়ে তোলা আওয়ামী লীগের কার্যলয় এখন বিএনপির দখলে। সরেজমিন দেখা যায় নতুন টিন লাগিয়ে কার্যালয় মেরামত করা হয়েছে। কার্যালয়ের গায়ে সাঁটানো হয়েছে ছাত্রদলের দুর্নীতিবিরোধী পোস্টার। তবে এখানেও কার্যালয়টি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ অগাস্ট রাতেই কার্যালয়টি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা।পরের দিন আবার সেটি মেরামত করে নিজেদের দখলে নেয়। চাঁদা আছে, চাঁদা নেই: ঢাকা শহরে সবখানেই যে চাঁদা তোলা হচ্ছে এমনটা নয়। একদিনে ঢাকার পাঁচটি স্পটে ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, এর মধ্যে চারটি স্পটেই চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা নেই। মূলত ফুটপাতের হকার, রাস্তার পাশের দোকান, পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব খাতে চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া যায়নি।  তবে মৎস ভবন এলাকায় কয়েকজন টং দোকানি জানিয়েছেন তাদের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছে।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলছিলেন, গত কয়েকদিনে দুটি গ্রুপ এসে চাঁদা দিতে হবে বলে জানিয়ে গেছে। গতকালকে একজন আইসা বইলা গ্যাছে, চাঁদা দেওয়া লাগবো। পরে আবার বিকালে আরেক গ্রুপ আইছে। বলছে ট্যাকা এখন থেইকা আমরা উঠামু, অন্য কাউরে দিবা না। আমি পরে কইছি, আপনারা আগে মিটিং কইরা ঠিক করেন কারে দিমু। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় আছে মার্কেটের দোকান দখল এবং গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার হস্তান্তর চেয়ে হুমকি দেয়ার ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৈরি পোশাক কারখানার একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের কারখানায় বিএনপির পরিচয়ে এসে ঝুটের ব্যবসা হস্তান্তরের জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ঝুটের ব্যবসা এখন আমরা করবো। অন্য কাউকে দিবেন না। কারখানায় এসে এরকম কথা বলে গেছে। হুমকি দিয়ে গেছে। দশটা/বারোটা মোটরসাইকেল নিয়ে কারখানায় ঢুকে। বলে যে বিএনপির অমুক নেতা পাঠিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিএনপি কী বলছে? আর সরকার কী করছে?:বাংলাদেশে গেলো ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে যে পালাবদল ঘটে তার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি এবং দখলের খবর উঠে আসে গণমাধ্যমগুলোতে। মূলত আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আসার পরপরই দলটির পক্ষ থেকে কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়।

সরকার পতনের রাতেই বরিশাল শহরে পুকুর ভরাট করে দখলের অভিযোগ ওঠে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীনের বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলে গত ১১ অগাস্ট বিলকিস জাহান শিরীনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়। যদিও দলীয় প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। বরিশালের মতোই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকলে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দখল কিংবা আধিপত্য বিস্তারসহ যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার পালা বদলের মধ্যেই দলের নেতাকর্মীরা এমন কর্মকাণ্ডে কেন জড়িয়ে পড়লেন? এমন প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, যতটা প্রচার হচ্ছে, বাস্তবে ততটা ঘটছে না।আমি বলবো না যে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটেনি। হয়তো ঘটেছে। কোথাও যদি কোনো আওয়ামী লীগের অফিস দখল করে নেয়া হয়ে থাকে, এটা দখলের প্রবৃত্তি থেকে আসেনি। এটা এসেছে মানুষের প্রতিবাদের প্রবৃত্তি থেকে। তবে আমাদের কাজ হলো সেটাকে নিবৃত্ত করা। এখানে আমরা নিবৃত্ত করার জন্য আমরা সব রকমের চেষ্টা করেছি এবং করে যাবো।

বিএনপি জানাচ্ছে, দলের সব স্তরে তাদের ভাষায় ‘যে কোন অপকর্ম’ থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এরপরও এসব ঘটনা থেমে নেই।

এমন প্রেক্ষাপটে কয়েকদিন আগেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন চাঁদাবাজ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এর মধ্যেই দেশের থানাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম শুরুর প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, এরকম কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, আমরা অলরেডি ওয়ার্নিং দিয়েছি। যদি এতে (কাজ) না হয়, তাহলে পুলিশই দেখবে এটা।

বাংলাদেশে কোনো একটি সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা দখলের যে পুরনো ব্যবস্থা, সেটির পরিবর্তন খুব একটা হয় না। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে 'সিস্টেম বদলে দেয়া'র কথা। এ বিষয়ে সরকারের উপর ছাত্র-জনতারও চাপ আছে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস