ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

মোবাইল ফোনে নজরদারি

দেশে চালু হচ্ছে ‘জিও লোকেশন’

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৩, ০৮:২৯ রাত  

বাংলাদেশে হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মানুষের জিও লোকেশন বা অবস্থান শনাক্ত করার প্রযুক্তি। তাই মোবাইল ফোনে নজরদারির নতুন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এ ব্যবস্থায় কোন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী কোথায় অবস্থান করছেন; তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। যা আগামী মাস (নভেম্বর) থেকেই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। 

জানা গেছে, মোবাইল ফোনে জিও লোকেশন চালু হলে অপারেটরদের সহায়তা নিয়ে কিংবা সহায়তা ছাড়াই একজন বা এক সঙ্গে অনেক মানুষের সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নজরদারির সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো। অর্থাৎ লোকটি ঠিক কোথায় আছেন এটি চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। আবার এ প্রযুক্তির সাথে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় করে ব্যক্তির জিও লোকেশন ছাড়াও এক সঙ্গে বহু মানুষের গতিবিধি বা মুভমেন্ট সম্পর্কেও জানতে পারবে নজরদারিতে জড়িত সংস্থাগুলো।

সরকার বলছে, ব্যবস্থাটি চালু করা হবে অপরাধ দমনে। এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে জনসাধারণের নিরাপত্তার জন্য অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরণে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহের জন্য পর্যবেক্ষণ কাজ পরিচালনা করা হবে। সব আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের চাহিদা অনুযায়ী জিও লোকেশনসহ অন্যান্য সুবিধা পাবে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গত ১২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে এই ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে ‘আইনসম্মতভাবে’ আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর একটি হলো আইএলআইএস। এ ছাড়া নজরদারির এ ব্যবস্থায় মোবাইল অপারেটররা ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠান এবং ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স) এর মতো সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সংস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

মানুষের অবস্থানের সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক মানুষের গতিবিধি জানা যাবে

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা এখনো আছে। এ ব্যবস্থায় একটি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহারকারী কোন এলাকায় রয়েছেন; তা জানা যায়। তবে সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায় না। নতুন ব্যবস্থা হবে আরও সুনির্দিষ্ট। ধরা যাক, একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এখন ঢাকার ফার্মগেট মোড়ে রয়েছেন। এখনকার ব্যবস্থায় সেখানকার মোবাইল নেটওয়ার্কের বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশনের (বিটিএস যা টাওয়ার নামে পরিচিত) আওতার তিনটি কেন্দ্রের (সেল) কোনটিতে গ্রাহক অবস্থান করছেন তা জানা যায়। যেহেতু বিটিএসের আওতা মোটামুটি বড় থাকে। ফলে গ্রাহকের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা যায় না।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও টেলিযোগাযোগ খাত সূত্র বলছে, নতুন ব্যবস্থায় ওই ব্যক্তি ফার্মগেট মোড়ের ঠিক কোন জায়গায় আছেন। সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে। ফলে ব্যক্তি কোন ভবনে রয়েছেন, তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে জানা যাবে বিপুলসংখ্যক মানুষের গতিবিধি। নতুন ব্যবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ছয় মাসের ‘জিও লোকেশন’ উপাত্ত সংরক্ষণ করা হবে। সেখান থেকে তার গতিবিধির এলাকা শনাক্ত করা সম্ভব। জিও লোকেশন হলো মোবাইল ফোন গ্রাহকের অবস্থানের তথ্য। একজন গ্রাহক মোবাইল ফোন নিয়ে যদি কোথাও যান, মোবাইল ফোন যদি সচল রাখেন, তাহলে তার অবস্থানের তথ্য জানা যায় জিও লোকেশনের মাধ্যমে।

একজন টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় বেশিসংখ্যক মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। কারণ প্রত্যেকের তথ্য আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে হয়। নতুন ব্যবস্থা কাজ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। এতে হাজার হাজার মানুষের জিও লোকেশন বিশ্লেষণ করা সহজ হয়ে যাবে।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, নজরদারির এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে নতুন হলেও বিশ্বে অনেক পুরনো। তার মতে, একজন গ্রাহকের মোবাইল ফোনটি একই সাথে ২-৩ বা আরও বেশি কাছাকাছি টাওয়ার থেকে সিগন্যাল পায় এবং এর মধ্যে যেটি সবচেয়ে শক্তিশালী তার মাধ্যমেই সে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। এখানে ‘একটি ট্রায়াংগুলেশন মেথড’ ব্যবহার করে বিভিন্ন উপকরণের সহায়তায় ওই মোবাইল ফোনটির সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা হবে। তিনি বলেন, সফটওয়্যার মোবাইল অপারেটরের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে থাকবে। সেখানে তারা জানবে ঠিক কোথায় আছে মোবাইল ফোনটি। সংশ্লিষ্ট ফোন অপারেটর সেই তথ্য সরকারি সংস্থাকে জানাবে। আবার সরকারি সংস্থা নিজেও কানেক্টেড থাকবে সিস্টেমে এবং এর মাধ্যমে তারা নিজেরাও টেলিকম অপারেটরের কন্ট্রোল পার্টের এক্সেস নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ফোনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটব সূত্র জানিয়েছে, যে জিও লোকেশন ব্যবস্থা চালুর জন্য বলা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করতে অপারেটরদের নতুন সফটওয়্যার ও সরঞ্জাম প্রয়োজন। তা কিনতে বড় অঙ্কের অর্থ দরকার। অ্যামটব এই অর্থ চেয়েছিল বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল (এসওএফ) থেকে তারা যে প্রকল্প দাখিল করেছে। 
এ প্রসঙ্গে অ্যামটবের মহাসচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ আইন ও এর আওতায় প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী মোবাইল অপারেটররা সেবা পরিচালনা করে আসছে। ওই আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অপারেটররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করে থাকে।

মূলত প্রতিটি ফোনের আইএমইআই নাম্বার আছে; যেটি ইউনিক নাম্বার। সেই নাম্বারকেই নজরদারির এই সিস্টেমে কানেক্ট করিয়ে দেয়া যাবে এবং একটি মোবাইলে যে কয়টি সিম থাকবে সব কয়টিকেই এক সাথে ট্র্যাক করা যাবে। বাংলাদেশে মোবাইল সেট রেজিস্ট্রার পদ্ধতি চালু আছে। ফলে প্রতিটি ফোনের আইএমআই নাম্বার কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। মোবাইল ফোন সেবাদানকারীরা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, উন্নত বিশ্বে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ব্যক্তি সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় অবস্থান করছেন; তার উপাত্ত ব্যবহার করা হয় জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে। ব্যক্তির নাম ও পরিচয় ব্যবহারকারীরা জানতে পারেন না।

আবু সাঈদ খান বলেন, নতুন ব্যবস্থায় গ্রাহকের ওপর নজরদারির জন্য সরঞ্জাম ও সফটওয়্যার কেনার অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকেই নেওয়া হবে। এটা মোবাইল অপারেটর বা সরকারি সংস্থা কোনোভাবেই পারে না। বাংলাদেশে মোবাইল অপারেটরগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে টেলিযোগাযোগ সেবা দিতে। মানুষের জিও লোকেশন উপাত্ত দিয়ে গোয়েন্দাগিরির সহযোগী হতে নয়।