ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উৎকণ্ঠা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: ডিসেম্বর ০২, ২০২৪, ০৮:৩২ রাত  

সংস্কার নাকি নির্বাচন আগে; সংবিধান বাতিল, পুনর্লিখন নাকি সংশোধন; তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও সমন্বয়কদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের রীতিমতো বাহাস চলছে। তবে সব ক্ষেত্রেই সরকারের তরফ থেকে সবাইকে ঐক্যমত থেকে ধৈর্য ধরার কথাও বলা হচ্ছে। দেশে এখন মানুষের মনে নানামুখী অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকারের ভেতরে অস্থিরতা, রাজনৈতিক দলের ভেতর অস্থিরতা, প্রশাসনের নানা স্থরে অস্থিরতা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ভেতর অস্থিরতা। চাল, পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনজীবনে অস্থিরতা। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই; মধ্যবিত্তদের যাপিতজীবনও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন। দাবি আদায়ে তারা সড়ক, মার্কেট ও বাজার অবরোধ করছেন। একাধিকবার সচিবালয়, সরকারি অফিসসহ নানা স্থান ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়েছেন। কিন্তু এখনো মাঠপর্যায়ের শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। সেখানে বিহারী ক্যাম্পে খুনোখুনি, প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটেছে। রাস্তায় নামলেই ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার ভয় মানুষকে তাড়া করছে। চুরি-ডাকাতি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় নামলেই পোহাতে হচ্ছে যানজটের ভোগান্তি। এর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা। হাসপাতালে বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। সরকারি হিসাবেই যা ইতোমধ্যে ৯০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুদূষণও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে; নগরবাসীর শরীরে বাসা বাঁধছে নানান রোগ-ব্যাধি। এর মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে নতুন বছর। এরই মধ্যে অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দেওয়া শুরু করেছে। এ নিয়েও রয়েছে ব্যাপক দুশ্চিন্তা। এত সব যন্ত্রণার চাপে পিষ্ট এখন রাজধানী ঢাকার কোটি মানুষ।

জানা গেছে, গত ৫ নভেম্বর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে তৃতীয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। রক্তে ভেজা আন্দোলনে হাত-পা ও চোখ হারানো হাজার হাজার ছাত্র ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আর্তনাদ, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির বোঝা বহন করে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এর পাশাপাশি সরকারকে বিপাকে ফেলতে পতিত শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের লোকজনের বিভিন্ন তৎপরতা চালচ্ছে। শিল্প-কারখানায় আগুন দিচ্ছে। গাজীপুরের গার্মেন্টস কারখানায় মাঝে মধ্যে শ্রমিক বিক্ষোভ চলছেই। শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেন আর হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগ পোহান। এই ঘটনা যেন শেষ হওয়ার নয়। এর মধ্যে অনেকে লুটপাট করছে। কখনো পিটিয়ে মেরে ফেলছে। গত এক মাসে এ ধরনের হত্যাকান্ড কতটি ঘটেছে; তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আর এতে করে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে; স্বস্তির পরিবর্তে সরকারকে কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অস্থির অবস্থার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া সম্ভবত একটি দিনও অতিবাহিত করতে পারেনি। সরকার স্থির হয়ে তার প্রধান কাজগুলো অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে মনোযোগী হতে পারবে কি না- এমন প্রশ্নই এখন জনমনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

যতই দিন যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হচ্ছে

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, মানুষ অনেক দিন ধরেই সংসারের খরচ কাটছাঁট করে চালিয়েছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। সরকার পরিবর্তনের পর মানুষ আশা করেছিল, চাপ কিছুটা কমবে। কিন্তু প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়ছে। বছর শেষে বাড়ি ভাড়াও বাড়তে পারে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে চিকিৎসা, লেখাপড়া ও যাতায়াতসহ অন্যান্য খরচও বাড়ছে। সেই অর্থে কিন্তু আয় বাড়ছে না। ফলে খাদ্যের তালিকা ছোট করতে হচ্ছে। খাদ্য কমে যাওয়ায় পুষ্টির ঘাটতি হয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব জিডিপির ওপর পড়বে একটা সময়। এই অবস্থা যদি চলমান থাকলে জীবনমানের চরম অবনতি হবে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আলাউদ্দিন বলেন, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে তিনি রাতে রিকশায় চলাচল  করতে চরম ভয় পাচ্ছেন না। যে কারণে কোনো কোনো দিন তিনি অফিস থেকে সিএনজি অটোরিকশায় বাসায় ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালা বদলের পর ঢাকার রাজপথসহ বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা কমছে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ গেট এলাকার চা বিক্রেতা স্বপন বলেন, ৫-৬ মাস আগেও তিনি প্রতিদিন যত টাকার চটপটি বিক্রি করতেন সাম্প্রতিক সময়ে তার অর্ধেকও পারছেন না। কারণ আগের তুলনায় ক্রেতা কম। তার ওপর সবজির দাম বাড়তি থাকায় আগের চেয়ে তার কম লাভ হচ্ছে। শুধু স্বপনই নন, ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীদেরও প্রায় একই মত। ক্রেতা কম। তাই আগের মতো ব্যবসা হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নগরবাসীকে ভাবাচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই লেগেই আছে। এর মধ্যে ছিনতাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ঘর থেকে বেরিয়েই নিরাপত্তা নিয়ে মানুষকে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। সঙ্গে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান মালামাল যে কোনো সময় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে- এই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। 
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বসবাসের জন্য ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম খারাপ শহর। দূষণ থেকে যানজট খারাপ শহরের সব কিছুই আছে এখানে। যত দিন যাচ্ছে; শহরের পরিবেশ ততই খারাপ হচ্ছে। নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প, শিল্প ও ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশকে অগ্রাহ্য করেছি। এখানে নাগরিক পরিষেবা খুবই দুর্বল। এখন ঢাকার মানুষের যে প্রাণশক্তি আছে; সেটাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখবে। দূষণের কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে চিকিৎসার করতে গিয়ে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। নদীর দূষণ বন্ধ করতে পারলে নদী জীবন্ত হয়ে উঠবে। হাউজিংয়ের জন্য ঢাকার আশপাশে বালু উত্তোলন এবং ইটভাটা বন্ধ করতে পারলে বায়ুদূষণও কমে যাবে। সব ধরনের চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে বসবাসের জন্য উপযোগী হয়ে গড়ে উঠবে।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মাত্র দুদিন আগে রাত ৯টার দিকে তিনি কাকরাইল মোড়ে ছিনতাই হতে দেখেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে রমনা থানার নাকের ডগায়। তিনি বলেন, পাশেই যে রমনা থানা এই ভীতিও কাজ করেনি ছিনতাইকারীদের মধ্যে। ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামছেন। অবরোধ করছেন সড়ক। এতে পথ-চলতি মানুষকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্ট ঘটনা। ঢাকার যে কোনো একটি পয়েন্টে সড়ক অবরোধ হলেই তার রেশ পড়ছে পুরো শহরে। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। রাজধানীর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্যই মাত্র কয়েক দিন আগেই ঢাকার পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দেয় সরকার। নতুন কমিশনার নিয়োগ করা হয় শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে তিনি বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হবে। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশ কাজ করছে। আর এক মাস পরই নতুন বছর শুরু হবে। বছর শেষ হওয়ার আগেই ইতোমধ্যে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া বৃদ্ধির মৌখিক ও লিখিত নোটিশ করতে শুরু করেছে। এতে নতুন করে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। 

আজিমপুরের গৃহবধূ কাকলী আক্তার বলেন, বছর শেষ হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে দেড় হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধি করার মৌখিক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। চাকরিজীবীর স্বামীর আয় বাড়েনি। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়লে তা কীভাবে মেটাবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

 দৈানক সরোবর/কেএমএএ