ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

মার্চে শুরু রমজান

অসাধু ব্যবসায়ীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৭:৩০ বিকাল  

নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম স্থিতিশীল রাখতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে তিনটি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। পণ্যের বাড়তি দামে বাজারে ভোক্তার রীতিমতো চলছে বোবাকান্না। এরই মধ্যে নুতন বছরের প্রথমাংশের মার্চে শুরু হচ্ছে রমজান। আর এই মাস ঘিরে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রমজান ঘিরে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। কারসাজি করে রমজাননির্ভর পণ্যে বাড়তি মুনাফা করতে তৎপর। সিন্ডিকেট করে ৪ মাস আগ থেকেই বাড়াচ্ছে দাম। এমন পরিস্থিতিতে এখন থেকেই এক প্রকার বিচলিত সরকার। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা কমিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে বড় কয়েক আমদানিকারকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সমঝোতার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা দেখবেন- বাজারে পণ্যের দাম যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক পর্যায়ে আছে। পাশাপাশি বাজারে হস্তক্ষেপ করা দরকার আছে কি না; তা বিশ্লেষণ করে বের করবেন। এতেও যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়; তাহলে কঠোর অবস্থানে গিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া পণ্যের দাম সহনীয় করতে কঠোরতায় না গিয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন উঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ব্যাংক থেকে যে কোনো পরিমাণ ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এ জন্য পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহও নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে কিছু পণ্যে আমদানিতে শুল্ক কমানো ও শূন্য শুল্ক সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। এতে আমদানি খরচ কমলেও বাজারে দাম কমছে না। সরকারের দেওয়া এসব সুবিধা চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। 

তথ্য মতে, আসন্ন রমজান কেন্দ্র করে ১১টি খাদ্যপণ্য আমদানিতে দেরিতে বিল পরিশোধের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আমদানিকারকরা রমজান সামনে রেখে এসব খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানি করতে পারবেন। পণ্যগুলো হলো- খেজুর, ছোলা, পেঁয়াজ, চাল, গম, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, মোটর ও মসলা। পণ্য আমদানি লেনদেন সহজ করতে রমজানের আগে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় এসব পণের বাড়তি চাহিদা থাকে। আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল থাকবে। 

কারওয়ান বাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, রোজা ঘিরে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা রোজা শুরুর আগেই সিন্ডিকেট শুরু করেছে। পণ্যের চাহিদা এখন না থাকলেও রোজায় অতি মুনাফা করতে এখন থেকেই ছোলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

চার মাস আগ থেকেই বাড়ছে রমজাননির্ভর পণ্যের দাম; নিয়ন্ত্রণে সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ ১১ খাদ্যপণ্য আমদানিতে থাকছে বিশেষ সুবিধা

সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবায় আজ জনজীবন বিপর্যস্ত। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজন কাটছাঁট করেও জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জীবনের বোঝা আজ বড্ড ভারী হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ জীবনের মৌলিকত্ব ভুলে গেছে। মানুষ আজ অসহায় হয়ে পড়েছে, জিম্মি হয়ে পড়েছে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সিন্ডিকেটের হাতে। তেল থেকে বেল, ওষুধ থেকে বিষ, ডাল থেকে চাল, ধান থেকে পাট, আলু থেকে জিরা, পেঁয়াজ থেকে আদা, ডিম থেকে আটা, খাতা থেকে বই, কলম থেকে বেতন, ইট-পাথর-রড-বালুÑকোনো কিছুই বাদ নেই। যেখানেই সিন্ডিকেটের হাত পড়েছে, সেখানেই ছড়িয়েছে আগুন। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নতুন সরকারের কাছে ভোক্তার প্রথম চাওয়া পণ্যের দাম কমানো। সরকার সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। সরবরাহ বাড়াতে একাধিক পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে। তদারকও করা হচ্ছে। তারপরও যেন কিছু পণ্য নিয়ে অসাধুরা কারসাজি করছে। কিছুদিন আগে ডিমের দাম বাড়লেও এখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এরপরও কিছু পণ্যের দাম এখনো বাড়তি। সেদিকে সরকারের নজর বাড়াতে হবে। পণ্যের দাম কমিয়ে ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হবে। দরকার হলে অসাধুদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের সরকারি পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সার্বিক দিকনির্দেশনায় রোজা ঘিরে এখন থেকেই বাজারে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। ডিমসহ কিছু পণ্যের দাম কমেছে। বাকি যে সব পণ্যের দাম অসহনীয় আছে তা শিগগিরই ক্রেতা সহনীয় হয়ে আসবে। আসন্ন রমজান ঘিরে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম স্থিতিশীল রাখতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে তিনটি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করছে। এর আওতায় রোজায় পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পণ্যের আমদানি বাড়াতে ডলারের জোগান দেওয়া হচ্ছে। 

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের প্রত্যাশাও ছিল- নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কমবে। কিন্তু বাজার কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না- এমন প্রশ্ন আরও জোরালো হচ্ছে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাজার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ছাত্র-জনতার অর্জন অনেকটা ম্লান হয়ে যাবে। বিগত সরকার রাজনৈতিকভাবে যতটা শক্তিশালী ছিল, ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। টাকার অবমূল্যায়ন ও সিন্ডিকেটের থাবায় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। আমাদের দেশের সমস্যা বহুমাত্রিক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের মুদ্রানীতি, সিস্টেম পলিসি, সুদনীতি, বিদেশি মুদ্রার ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পলিসি জড়িত। তবে আমাদের প্রত্যাশা, বিগত সরকার যা ১৬ বছরে পারেননি সেই কঠিন কাজটি এ যুগের তরুণদের দ্বারা অসম্ভব নয়। জনগণের কাছে এখন তারা আস্থার প্রতীক। তিনি বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙাসহ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। ভোক্তার স্বার্থ দেখার দায়িত্ব সরকারের। বস্তুত অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির করে তোলে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক সংস্কার কর্মসূচিই বাধাগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় এনে বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, করপোরেট ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই বাজারে অস্থিরতা। প্রতিশ্রুতির দিনের তালিকায় দিন যোগ হয় কিন্তু পণ্যের দাম কমে না। আরও বাড়তি টাকা গুনতে হয় ভোক্তাদের। কিন্তু বাড়ছে না মানুষের আয়। ফলে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির, বিশেষ করে স্থির আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল; ক্রমেই তা হতাশায় রূপ নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এটি যদি সত্য হয় তাহলে ব্যর্থতা কাদের? উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বহুদিন ধরেই অস্বস্তিতে রয়েছে সাধারণ মানুষ। বস্তুত নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতার মূল কারণগুলো চিহ্নিত; সমস্যার সমাধানে কী করণীয় তাও বহুল আলোচিত। আলোচিত সমস্যার সমাধানে জোরালো বাজার তদারকি অব্যাহত রাখা দরকার। 

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ