ঢাকা, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

গুম: স্বাধীনতার পর প্রথম তদন্ত কমিশন 

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৪, ০৯:১১ রাত  

স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো  অর্ন্তবর্তী সরকার গুমের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছে। গুমকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ উল্লেখ করে তা তদন্তে কমিশন গঠনের বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। গত ১৪ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।

কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, এটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। কারণ গুম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। গুমকে যদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কেউ ব্যবহার করে সেটি আরো অনেক বড় অপরাধ। যারা এ ধরনের অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া বা বিচারের দ্বারস্থ করা এটা অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে আর না হয়। এ সমস্ত অভিযোগের দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এড়াতে পারবে না বলে মনে করছেন মি. খান।

তবে এসব গুমের ঘটনায় ঢালাওভাবে বাহিনীকে দায়ী করা যাবে না বলে মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ রাষ্ট্রের এ শীর্ষ আইন কর্মকর্তার।

কমিশনের আকার ও কার্যপরিধি: মঙ্গলবার কমিশন গঠন করে দেয়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পাঁচ সদস্যের এ কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল হোসেন চৌধুরী। অন্য সদস্যরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকার কর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ হোসেন। বেসামরিক বাহিনীর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাকেও কমিশনের তদন্তের আওতায় রাখা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের নিমিত্ত কমিশনটি গঠন করা হয়েছে।

এর যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো- ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত করা এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল সেটা নির্ধারণ করা; জোরপূর্বক গুমের ঘটনাসমূহের বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা এবং এ ব্যাপারে সুপারিশ প্রদান; গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে আত্মীয় স্বজনকে অবহিত করা; গুমের ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, কমিশনকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

'অনুদঘাটিত বিষয়ে কাজ করতে পারবো': কমিশনের সদস্য নূর খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, পারিপার্শ্বিকতা এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি পাওয়ার ঘটনা- সব মিলিয়ে এই বিষয়গুলো পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ বাহিনীগুলোর নেই। যেহেতু একটা কমিশন গঠন হয়েছে, আমি নিশ্চিত এই কমিশন দ্বারা অনুদঘাটিত অনেকগুলো বিষয়ে আমরা কাজ করতে পারবো, আমার বিশ্বাস।

গত ১৫ বছরে বাহিনীগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং জনগণের মুখোমুখি যেভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল তাতে এই বাহিনীগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ফলে নতুন করে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

‘এই বাহিনীগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের অনাস্থা জনমনে রয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই বাহিনীগুলো বিলুপ্ত হবে নাকি সংস্কার হবে নাকি বাহিনীগুলোর জায়গায় নতুন বাহিনী আসবে এটা বলা খুব কঠিন। কারণ এ বিষয়টি সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ারের বিষয়’-বলেন খান।

একই সাথে আস্থার জায়গা মজবুত করতেই প্রকৃত সত্য ঘটনা উদঘাটন দ্রুত করতে হবে বলে মনে করছেন খান। ‘দ্রুত যদি এই বিষয়গুলো মোটামুটি উদঘাটন করা সম্ভব হয় তাহলে একটা শক্ত বার্তা যাবে যারা এ ধরনের ঘটনার সাথে যুক্ত তাদের কাছে। একইসাথে জনগণের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে যে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়া যায় না’-বলেন খান। ‘ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না’: এ কমিশন গঠনকে ভালো পদক্ষেপ হিসেবে বলছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, যারা এতোদিন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, বিনা বিচারে আত্মীয়স্বজন গুম, খুন হয়েছেন তারা ন্যায় বিচার পাওয়ার আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। এটাকে গুড ইনিশিয়েটিভ হিসেবে দেখতে পাচ্ছি অবশ্যই। কমিশনের মূল দায়িত্ব হলো সত্য উদঘাটন করা। এ লক্ষ্যে কমিশনের যা যা করণীয় তারা সেটি করবেন বলে মনে করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তবে ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, আমি ব্যক্তির লায়াবিলিটির সাথে বাহিনীকে এক করতে চাই না। যেসব ব্যক্তি লায়াবেল তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত। ফলে যারা এখানে অপরাধ করেছে তাদেরটা তাদের মতো হবে এটার জন্য বাহিনীর উপর আসবে বলে মনে করি না। যা বলছেন গুম হওয়া পরিবারের স্বজনরা: আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, বিনা বিচারে ক্রসফায়ারের অভিযোগ ছিল। কিন্তু সে সময় সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কয়েকজন ব্যক্তি ‘আয়নাঘর’ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন। এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমেদ বিন কাশেম আরমান, জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ এর সংগঠক মাইকেল চাকমা পাঁচ বছরের বেশি সময় পর ফিরে এসেছেন।

যেসব ব্যক্তি ওই শাসনামলে গুম হয়েছেন তাদের স্বজনদের একটি সংগঠন মায়ের ডাক। এ সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা তুলির ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে ২০১৩   ৪ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। এক লিখিত বার্তায় এই কমিশন গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। কমিশনের প্রতিটি রিপোর্টের তথ্য পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশের দাবিও জানান তিনি।

তিনি বলেন, কোনো তথ্য যাতে গোপন করা না হয় এটা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবেদন কমিশনের কাছে। আশা করবো এই স্বচ্ছতা আমাদের সাথে থাকবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে। 

তুলি বলেন, মানবাধিকারের নীতিগুলোতে যেন মালিকানা, অংশীদারিত্ব, বৈষম্যহীনতা এবং স্বচ্ছতা থাকে। সেখানে অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিক, ভুক্তভোগী পরিবার এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিক যারা ছিলেন তাদের কথাগুলো জানানোর এবং জানার জন্য অংশগ্রহণমূলকভাবে সুযোগ যেন দেয়া হয়। এভিডেন্সগুলো ওই প্রসেসে সাবমিট করতে পারে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস