অসাধু চক্রের খপ্পর
ডিমের বাজারে ফের কারসাজি
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৪, ০৮:০১ রাত

চাহিদা-জোগান কিংবা উৎপাদন খরচ অনুযায়ী নয়, ডিমের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু চক্র। পেঁয়াজ-আলুর মতো এখন ডিমও বিপুল পরিমাণে মজুদ করা হচ্ছে গোপনে। যোগসাজশ করে বেশি দামে ছাড়া হচ্ছে বাজারে। এসএমএসের মাধ্যমে দাম ঠিক করে দিচ্ছে ব্যবসায়ী সমিতিগুলো। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ১০ টাকা ৩০ পয়সায় কেনা ডিম বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৪ টাকায়।
স্বল্প আয়ের মানুষের পাত থেকে অনেক আগেই বাদ পড়েছে মাছ-মাংস। আমিষের চাহিদা পূরণে ভরসা ছিল ডিম। সেটি নিয়েও চলছে কারসাজি। ডিমের বাজারে ফের কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অবৈধ মজুত করে তারা বাজার অস্থির করছে। সরবরাহ কমিয়ে বাড়িয়েছে দাম। পরিস্থিতি এমন খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ডিম কিনতে ক্রেতার সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে; যা সাত দিন আগেও ১২০-১২৫ টাকা ছিল।
রাজধানীর মালিবাগবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, বাজারে যে কী শুরু হয়েছে; তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। বিক্রেতারা একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাসাধারণকে নাজেহাল করে তুলছে। সময়-সুযোগ বুঝে ক্রেতার পকেট কাটছে। এবার ডিমের দাম বাড়িয়ে বাজারে ফের অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিম কম দামে সংগ্রহ করে মজুদ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ী সমিতিগুলো দেশজুড়ে জাল বিছিয়েছে। তারা মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে দর বেঁধে দিচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে ভালো দাম পাচ্ছেন না খামারিরা আর ভোক্তারা বেশি দামে কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থার প্রসঙ্গ উঠলে একইসাথে আলোচনায় আসে সিন্ডিকেট শব্দটি। সিন্ডিকেট বলতে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া বা নির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলকে বোঝানো হয়। এ কাজ ভালো কিংবা খারাপ দুটোই হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সিন্ডিকেট বলতে মূলত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বোঝায় এবং এই শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার হয়ে আসছে। যেখানে এক দল ব্যবসায়ী বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ইচ্ছামতো পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাম বাড়িয়ে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করে। অভিযোগ আছে এরকম ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদনে কোনও ঘাটতি না থাকা এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার পরও তারা গুদামজাত করে এবং সংকটের কথা বলে বেশি দামে বিক্রি করে। এতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
খুদে বার্তায় নির্ধারণ হচ্ছে দাম; ১০.৩০ টাকায় কেনা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়
ডিম ব্যবসায়ী সমিতিকে সরাসরি দায়ী করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জানান, কারা কীভাবে এসএমএস করে ডিমের দাম ঠিক করছে; সেই তথ্য তাদের কাছে আছে। ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে ডিমের বাজারদর ঠিক করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেন তিনি। এরপরও সমিতিগুলোর তৎপরতা থামেনি। জানা গেছে, ব্যবসায়ী সমিতিগুলো বিশেষ করে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি এখনো ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে এসএমএস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা ছড়াচ্ছে। সে অনুযায়ী অন্যান্য সমিতি বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ডিমের দাম বাড়ার কারণ জানতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে ডিমের বাজার অস্থিরতার পেছনে অবৈধভাবে মজুতের তথ্য পাওয়া গেছে। তদারকির মাধ্যমে তা সমাধান করা হবে। রাজধানীর বড় ডিমের আড়তেও অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি মুরগির বাজারেও কঠোরভাবে তদারকি করা হচ্ছে। সূত্রমতে, মাস দেড়েক আগেও নরসিংদী জেলার সদর উপজেলার এক হিমাগার থেকে ১৪ লাখ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার আরেক হিমাগার থেকে ২৮ লাখ ডিমের মজুদের সন্ধান মেলে। বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের এমন বিপুল পরিমাণে ডিম মজুদ সন্দেহজনক এবং বাজার অস্থির করার পাঁয়তারা বলে ধারণা করছে ভোক্তা অধিদপ্তর। এ প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, খামার, এজেন্ট, ডিলার ও ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে ভোক্তা অধিদপ্তর।
এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কারসাজিকারীরা চিহ্নিত হলেও তাদের দেওয়া হয় লঘু দন্ড। সম্প্রতি আড়াই লাখ ডিমের মজুদ উদ্ধারের পর জরিমানা করা হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। যে জরিমানা করা হচ্ছে তাতে কারসাজিকারীদের কিছু যায় আসে না। লঘু দন্ডের কারণে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে এবং কারসাজির প্রবণতাও বাড়ছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে বিভিন্ন জেলায় ডিমের বিপুল মজুদের খবর বেরিয়ে আসছে। পাইকারি ও খুচরা বাজারেও তদারকি করে পাওয়া যাচ্ছে নানা অনিয়ম ও কারসাজির তথ্য।
এ বিষয়ে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, সমিতিগুলো সক্রিয়। কিছুই বদলায়নি। তবে নতুন করে দাম আর বাড়েনি। ডিমের বর্তমান উৎপাদন খরচ বিবেচনায় খুচরায় প্রতিটি ১২ টাকার বেশি দামে বিক্রি হওয়া অযৌক্তিক। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে উৎপাদন পর্যায়ে যে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ„