ঋণ খেলাপি হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে পাকিস্তান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৩, ০৫:৫৯ বিকাল

আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি ফিচের বিবেচনায় পাকিস্তান বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপিতে পরিণত হওয়ার ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ পড়েছে।
গত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মত দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও ফিচের এই মূল্যায়ন দেশটিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে আইএমএফ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যে ফিচের এই মূল্যায়ন একটি বড় ধাক্কাও বটে।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফিচ পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুকারী ডিফল্ট রেটিং ‘সিসিসি প্লাস’ থেকে কমিয়ে ‘সিসিসি মাইনাস’ করে দিয়েছে।
এর অর্থ হলো পাকিস্তান উচ্চমাত্রায় খেলাপির ঝুঁকিতে আছে। রিজার্ভের টানা পতন, তারল্য প্রবাহ কমতে থাকা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই মূল্যায়ন করেছে ফিচ।
১৯১৩ সালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ফিচ । ওইসময় প্রতিষ্ঠানটি শিল্প বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নিয়ে ‘দ্য ফিচ স্টক অ্যান্ড বন্ড ম্যানুয়াল’ এবং ‘দ্য ফিচ বন্ড বুক’ নামের দুটো প্রকাশনা বের করত। এরপর ১৯২৪ সালে তারা রেটিং কার্যক্রম শুরু করে।
বর্তমানে বিশ্বের ত্রিশটি দেশে কার্যক্রম চালু রয়েছে ফিচের, যৌথভাবে যার মালিকানায় রয়েছে প্যারিসভিত্তিক ফিমালাক এসএ এবং নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হার্টস কর্পোরেশন।
সার্বভৌম রেটিংয়ে' একটি দেশে বিনিয়োগের নানা ঝুঁকি বিবেচনা করে তাকে সুনির্দিষ্ট 'গ্রেড' দেয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের রেটিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কেননা এ ধরনের রেটিংয়ে কোনো নির্দিষ্ট দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকিও বিশ্লেষণ করা হয়।
পাকিস্তান নিয়ে এই মূল্যায়নের পর নিজেদের পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়ে ফিচ বলেছে, বৈদেশিক তারল্য প্রবাহ ও তহবিল পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে খারাপের দিকে যেতে থাকায় এবং রিজার্ভ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে থাকার কারণে পাকিস্তানের রেটিং কমাতে হয়েছে তাদেরকে।
২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খানের নেতৃত্বে থাকা সরকারকে সংসদে আস্থাভোটে হারিয়ে শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের পর এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক তিনটি রেটিং এজেন্সি পাকিস্তানের রেটিং কমিয়েছে। এর আগে আর কখনও এমন ঘটেনি পাকিস্তানে।
রিজার্ভের ইউটার্নে স্বস্তি; ফিচের এই মূল্যায়নের মধ্যে একটি ‘স্বস্তি’র খবর জানিয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টানা কয়েক মাস কমার পর অবশেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে সে দেশের। তবে এখনও যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে, তা দেশটির এক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি দেশটির রিজার্ভ আগের সপ্তাহের চেয়ে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বেড়ে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। আমদানি বিল মেটানোর পর আগের সপ্তাহে এই রিজার্ভ ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। সে সময় দেশটির অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্ক জেঁকে বসে।
আরিফ হাবিব লিমিটেড নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেব করে দেখিয়েছে, রিজার্ভের ওই অর্থে দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ের আমদানি বিল মেটানো সম্ভব।
অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা অর্থের বাইরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে আছে আরও সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে দেশটিতে বিদেশি মুদ্রার মজুদ ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
এ পরিস্থিতিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে নিজেদের খেলাপি ঘোষণা করে। পাকিস্তানকেও সে পথে হাঁটতে হয় কি না, তা নিয়ে দেশটিতে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ।
এই পরিণতি থেকে বাঁচতে পাকিস্তান আইএমএফের ঋণ পেতে তাদের শর্ত পূরণে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। শর্ত পূরণে জ্বালানির দাম বাড়ানোর পাশাপাশি দেশটির সরকার নতুন করে ১৭০ বিলিয়ন রুপি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বৃহৎ শিল্পের ওপর ৪ শতাংশ ‘সুপার ট্যাক্স’ আরোপ করা হয়েছে। এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে একটি পক্ষ আদালতে গেলে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বলেছে, সরকারের ওই আদেশ বৈধ।
এই পদক্ষেপে সরকারের আয় বাড়লেও উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগতে থাকা দেশটিতে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাচ্ছে যা সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে।
আইএমএফ থেকে পাকিস্তান ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে নবম দফার বৈঠকেও কর্মকর্তা পর্যায়ের কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ। ওই ঋণের প্রথম কিস্তির ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের আশায় উদগ্রীব হয়ে আছে পাকিস্তান। দেশটি আশা করছে, আইএমএফের ঋণ পাওয়া গেলে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকেও সহায়তা আসবে।
এই ঋণ পাওয়ার আশায় গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ১০ দিন আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে দেশটির সরকার। তবে তারা সমঝোতায় পৌঁছতে না পারেনি।
আইএমএফ জানিয়েছে, তাদের আলোচনা ভেস্তে যায়নি। চুক্তি চূড়ান্ত করতে আগামী দিনেও আলোচনা চালু থাকবে।
আইএমএফ থেকে ঋণ যদি মেলেও, তারপরেও পুরোপুরি স্বস্তিতে থাকতে পারছে না দেশটি। কারণ চলতি বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে, সেই পরিমাণ ডলার জোগাড় করা কঠিন হয়ে যাবে দেশটির জন্য। এক হিসাব অনুযায়ী আগামী ১২ মাসে ২২ বিলিয়ন ডলার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে পাকিস্তানকে।