নিরাপদ হোক ঢাকার আবাসন
প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২৩, ০৬:০৯ বিকাল

ঢাকায় প্রায়শই বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। দেখা যাচ্ছে ভবনের কোনোটিতে লাগছে আগুন, কোনোটি পড়ছে হেলে আবার কোনটিতে ধসে পড়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে।
মঙ্গলবার গুলিস্তনের সিদ্দিকবাজারের একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজধানীবাসীর মনের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা উদ্বেগ-আতংক নতুনমাত্রায় জেগে উঠেছে। এই বিস্ফোরণে ১ কি.মি এলাকাজুড়ে কম্পন্ন সৃষ্টি করে। রাজধানী জুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের অভাব নেই। ফলে মানুষ এটাও ভাবছে যে ভূমিকম্প হলে ঢাকার কি হবে, কতটা বিপর্যয়-ধ্বংস নেমে আসবে সামনে।
ফলে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কেন দ্রুততার সঙ্গে ভেঙে ফেলা হচ্ছে না, বা এগুলোতে পরিত্যক্ত ও বসবাস অনুপোযোগীর সাইনবোর্ড টানিয়ে তাতে সিলগালা করা হচ্ছে না, যাতে একটি লোকও তাতে না থাকে। এটি করার দায় বা কর্তব্য কার ওপর বর্তায়? তা নিশ্চয় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অজানা নয় এবং সর্বসাধারণও মনে করে প্রধানত এটি রাজউকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণের বেলাতেও বিল্ডিং কোড মেনে চলার প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। রাজউকের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এটি সম্ভব তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। সিদ্দিকবাজারের ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে নানা খবর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিস্ফোরণের আসল ঘটনা জানতে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারাই হয়তো সেটি জানাবে।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন রাজধানীতে ৩২১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজউক জানিয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ১৫৫। ২০১৬ সালের ১৭ মে ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান জানান, নগরীতে ১১০ ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে ২০০৯ সালে এক জরিপের বরাত দিয়ে রাজউক জানিয়েছিল, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন প্রায় ৭২ হাজার।
সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-পুলিশ স্টেশনের ভবনগুলোর ওপর জরিপ চালায়। এতে ৩ হাজার ২৫২ ভবনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৮৭ ভবন পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব। আর ৪২টি ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সেগুলোকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকশার বাইরে অনেক ভবনে অতিরিক্ত তলা বাড়ানো হয়েছে। তলা বাড়ালে কলামের ওপর লোড বেড়ে যায়। অনেকে ভবনের চারপাশ বাড়িয়ে নেয়। এমনকি সিঁড়ি নকশা অনুযায়ী না করে সরু করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে সেই সিঁড়ির দরজা সব সময় বন্ধ করে রাখে। অনেকে ভবনে অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী রাখে না। এ রকম অনেক কারণেই ভবনগুলো ঝুঁকিতে পড়ে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন কারণেই ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হয়তো একটি ফ্ল্যাট নকশায় দেড় হাজার বর্গফুট হওয়ার কথা। সেখানে ১০০ বর্গফুট বাড়ানো হলে সেটাও এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। পয়েন্ট অব ভিউ থেকে হয়তো সেই ঝুঁকিটা কম। তবে এগুলোর সংশোধন করে নেওয়া দরকার। এ জন্য রাজউকের আঞ্চলিক কার্যালয় আছে। সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড আছে। এভাবে ভাগ করে প্রতিটি ভবন পরিদর্শন করা দরকার।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের চেয়ে রিহ্যাব সদস্যদের তৈরি করা ভবন অনেক মানসম্মত। এফআর টাওয়ারে অগ্নিকা- ছাড়া রিহ্যাবের কোনো ভবনে কখনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে মার্কেটগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। গাউছিয়া মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, নিউ মার্কেট, মৌচাক মার্কেট– এমনকি গুলশানের পিংক সিটি মার্কেটে গেলে দেখবেন ওপেন স্পেসে দোকান বসিয়েছে। কোথাও আবার ফুডকোর্ট বানানো হয়েছে। যেখানে রান্না হয়, সেখানেই গ্যাস ও আগুন থাকে। তাহলে তো ঝুঁকিও থাকে। রাজউকের তদারকির অভাবে এসব ঘটছে।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৪১ ভবন আর মার্কেটে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বসবাস আর বাণিজ্য। দৃশ্যমান স্থানে টানানো লাল সাইনবোর্ডের নোটিশে ভবনের বাসিন্দা ও বসবাসরতদের সরে যেতে বলা হলেও কেউ কানে তুলছে না। বরং সিটি করপোরেশন প্রতিমাসে ভাড়াও আদায় করছে। এসব ভবন দিনে দিনে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘এসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সবাইকে নোটিশ ও মাইকিং করা হয়েছে, যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে সরে যায়। এর মধ্যে কিছু ভবন নিলামের প্রক্রিয়া চলছে, নিলাম শেষে ভেঙে ফেলা হবে। নোটিশ দেওয়ার পরও যেহেতু তারা বসবাস ও ব্যবসা পরিচালনা করছেন তাই তাদের রাজস্ব দিতে হবে। সচেতন মানুষ যদি জেনেশুনে বিপদে পড়তে চায় তাহলে তার দায়িত্ব বসবাসকারীদের ওপরই বর্তায়। কারণ, তাদের এসব ভবন ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার চেষ্টা করছি। কিছু মার্কেটে মামলা থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।’
জানা যায়, ২০২০ সালে ডিএসসিসির ৯টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। আর ডিএসসিসির ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসংক্রান্ত আঞ্চলিক কমিটি ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৬টি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট, ভবন আর স্টাফ কোয়ার্টারের ভবন চিহ্নিত করে। এছাড়া ২৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দৃশ্যমান স্থানে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনসংবলিত লাল সাইনবোর্ড’ স্থাপন করে জানমাল রক্ষায় ভেঙে অপসারণের জন্য ভবন মালিকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তবে বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) গিয়ে কয়েকটি ভবনে ‘লাল সাইনবোর্ড’ ঝুলতে দেখা যায়নি।
গত ২১ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার, ১৪ নম্বর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার, ১৪ নম্বর আউটফল সুইপার বস্তির ভেতর, দয়াগঞ্জ কানপুর ক্লিনার কলোনি এবং দয়াগঞ্জ ট্রাক স্ট্যান্ড রোডসাইড মার্কেটের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বসবাসকারীদের ভবন খালি করতে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এ গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে বসবাসকারীদের অনেকেই জানেন না। পাকিস্তান আমলের এসব ভবন বেশ নাজুক।
বছরখানেক আগে ১০ নম্বর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টারের কয়েকটি ভবনের ছাদ সংস্কারের সময় নতুন করে রড দিয়ে ঢালাই করা হয়। দয়াগঞ্জের কানপুর ক্লিনার কলোনি আর ট্রাকস্ট্যান্ড রোডসাইড মার্কেটটি মেয়র সাঈদ খোকন তাঁর আমলে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত দেন। তবে এ দুই ভবনের নিচতলার দোকানি আর ওপর তলার বাসিন্দারা তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে ভাঙার দাবি জানান। ৭৩০টি দোকান থাকা নওয়াব ইউসুফ মার্কেটের নিচতলায় হার্ডওয়্যার, পলিথিন, লোহালক্কড়ের দোকান, দ্বিতীয় তলায় ব্যাগ, কার্টনের কারখানা, গার্মেন্টস আর মাঝখানে কাঁচাবাজার।
সরেজমিনে দেখা যায়, দোতলা এ মার্কেটের ছাদের পলেস্তারা খসে রড বের হয়ে আছে, রেলিং ধসে পড়েছে। ব্যবহার অনুপযোগী কয়েকটি দোকানে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করছেন ব্যবসায়ীরা। ঝুঁকিপূর্ণ এ মার্কেটটিতে কোথাও লাল সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। বরং ছয় ভবনের মাঝখানের কাঁচাবাজারটি ইজারা দিতে গত ১২ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ডিএসসিসি। আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, ঠাটারিবাজার মার্কেট, খিলগাঁও রেলওয়ে কাঁচাবাজার মার্কেট, বংশাল কমিউনিটি সেন্টার, রোকনপুর কমিউনিটি সেন্টার আর ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টারটি ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় আছে।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ৯টি মার্কেট ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেয় ডিএনসিসি। মার্কেটগুলো হলো–মোহাম্মদপুর টাউন হল পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার, গুলশান উত্তর কাঁচা মার্কেট, গুলশান দক্ষিণ পাকা মার্কেট, রায়েরবাজার মার্কেট, কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ১ নং ভবন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ২ নং ভবন মার্কেট ও কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়ত মার্কেট। এগুলো ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটের ছাদের পলেস্তারা খসে রড বের হয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় লোহার পাইপ দিয়ে ছাদ ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে।
আরবান স্টাডিজ গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় ১ হাজার ৮৩১টি শত বছরের পুরোনো ভবন আছে। এসব ভবনের অধিকাংশই জীর্ণ। এখন জোর দিয়ে বলা যায়, রাজধানী মৃত্যুকূপ করে তোলার জন্য যারা দায়ি এবং অপরাধী, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিতে কেন হিমশিম খাবে। সরকার রাজধানী লাখ লাখ মানুষের জীবনের ঝুঁকির মধ্যে কেন ফেলে রাখবে গুটিকয় মানুষের জন্য।
এ ব্যাপারে খোদ সরকার প্রধানের তরফ থেকে নির্দেশ আসা উচিত বলে আমরা মনে করি। তিনি যদি রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সম্বন্ধে একটু খোঁজ-খবর নেন, তাহলে নিজেই বিচলিত বোধ করবেন এটা জোরের সাথে বলা যায়।
মানুষের বসবাসের জন্য প্রচ- ঝুঁকিতে থাকুক, এটা নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইবেন না। তিনি অবশ্যই অধীনস্তদের কর্তব্য অবেহলার জন্য কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করাবেন। তার জনগণ মৃত্যুকূপে বসবাস করুক, এটা তিনি কোনওভাবেই চাইবেন না। ফলে আমরা বলতে চাই, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহ বিল্ডিং কোড মেনে যারা ভবন তৈরি করেনি এবং করছে না, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রগণ আমরা দেখতে চাই।
রাজধানীবাসী জীবন স্বাভাবিক থাকুক এটাই চাওয়া আমাদের।
দৈনিক সরোবর/ আরএস