ঢাকা, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

নতুন নেতাদের নিয়ন্ত্রণেও পরিবহনের অব্যবস্থাপনা 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২৫, ০৭:৪১ বিকাল  

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়া এসব নেতা গাঢাকা দিয়েছেন। পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে নতুন নেতাদের হাতে। তারা কিছু কর্মসূচি নিলেও ব্যাপক সংস্কার ছাড়া পরিবহনের অব্যবস্থাপনা দূর করা, শৃঙ্খলা আনা এবং উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। দেশের পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা নতুন কিছু নয়, বেশ পুরনো অভিযোগ। শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সুফল মেলেনি। গত সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকায় পরিবহন খাতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বলয় গড়ে ওঠে। সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হন কয়েকজন নেতা। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন সাধারণ পরিবহন মালিক, শ্রমিকরা ও যাত্রীরা। 

জানা গেছে, সড়ক পরিবহনের দুই প্রধান সমস্যা হলো যানবাহনের ফিটনেস না থাকা এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়া চালকদের গাড়ি চালানো। অবৈধ চালকই আছেন ৯  লাখ, আর শুধু ঢাকাতেই স্বীকৃত মতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা সোয়া দুই লাখের বেশি। এর উপরে রয়েছে পরিবহন মালিকদের কথা ও কাজে গরমিল। সড়কে বেপরোয়া ও পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো শুধু কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল চালকের কাণ্ড নয়; এর নেপথ্যের বড় কারণ চালকদের কাছে চুক্তিতে বাস-মিনিবাস চালাতে দেওয়া। মালিক শুধু দেখেন চুক্তির টাকা উশুল হলো কি না। এরপর চালক-হেলপার কত কম সময়ে কত বেশি ট্রিপ দিয়ে কত টাকা আয় করে নিলেন, সেসব দেখার কেউ নেই। মূলত এই দ্বিমুখী বেআইনি কর্মকাণ্ডই সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনার বড় কারণ। 

এদিকে সারা দেশের সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রঙচটা লক্কড়-ঝক্কড় বাস-মিনিবাস। ফিটনেস না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের সামনেই রাজপথে চলছে এসব যানবাহন। অথচ খালি চোখেই ধরা পড়ছে বাসগুলোর বেহাল অবস্থা। জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ এসব বাহনে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এসব গাড়িই সড়কে বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ। যত্রতত্র বিকল হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফলে  প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে কেউ হারাচ্ছেন জীবন; আবার কেউ অঙ্গ হারিয়ে বোঝা হচ্ছেন পরিবারে।

সূত্র মতে, উচ্ছৃঙ্খল পরিবহনে সড়কের বিশৃঙ্খলা নিয়ে পরিবহন মালিক, চালক, পুলিশ, বিআরটিএসহ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কারোরই কিছু অজানা নেই। সব মিলিয়ে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলার লেশমাত্র নেই। রমজান মাস কেন্দ্র করে নগরবাসীর মনে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম আতঙ্ক। এরমধ্যে বিআরটিএ মাঝে মধ্যে আশার বাণী শোনালেও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে সিটি করপোরেশন। 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় বাস উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এমন পদক্ষেপ ঠেকাতে ফিটনেসবিহীন পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো রাতারাতি গোলাপি রঙ ধারণ করে চালাতে গিয়ে নগরজুড়ে প্রতিদিন গণপরিবহন সংকটে ভয়াবহ যাত্রী দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে। বাসের ভাড়া নির্ধারণের শর্ত লঙ্ঘন করে এমন অব্যবস্থাপনায় গণপরিবহনে ভয়াবহ যাত্রী দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে নগরজুড়ে। রাজধানীতে গণপরিবহনগুলোর কর্মীরা নিজেদের মর্জি মতো চালাচ্ছেন গাড়ি। এর পাশাপাশি যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছেন ইচ্ছামাফিক ভাড়া। রাজধানীজুড়ে পরিবহন খাতে এমন নৈরাজ্য হরহামেশা চলতে থাকলেও বিশেষ কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করছেন। তবে বিআরটিএর কার্যক্রম অনুযায়ী যানবাহনের ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো বন্ধ, পরিবহন শ্রমিকদের মাদক গ্রহণ বন্ধ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিশেষ করে ১৬টি কাজ করছে সংস্থাটি। কিন্তু মূলত এসব বিষয়কে সংস্থাটি প্রাধান্য না দেওয়ায় সড়কজুড়ে বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা।

সারদেশের অবৈধ চালকের সংখ্যা ৯ লাখ, শুধু ঢাকাতেই সোয়া দুই লাখের বেশি

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন যেন কোনো খবরই নয়! অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার ব্যাপারে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় কুকুর-শিয়ালের মৃত্যু হলে যতটা শোরগোল হয়, তার ছিটেফোঁটাও হয় না মানুষের মৃত্যুতে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হবে; এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই এ নিয়ে কথা বলার তো কিছুই দেখি না। প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভার সরকার কিংবা গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে এমনিতেই কমে যাবে দুর্ঘটনার পরিমাণ। এর জন্য লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন যেমন দায়ী, তেমনই বেপরোয়া ও অসচেতন পথচারীদের দায়ও কম নহে।

ফিটনেসবিহীন বাস চলাচলকে প্রতারণা উল্লেখ করে যাত্রী নাজিয়া আক্তার বলেন, মালিক সমিতি ইচ্ছা করলেই এসব বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তারা ট্রাফিকের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। 

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমে চাঁদাবাজি বন্ধ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোদৈহিক ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে আন্তজেলা ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমানোসহ আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

একাধিক পরিবহন শ্রমিক (চালক ও হেলপার) জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দলটির রাজনীতি করা নেতাদের কাছে পরিবহন খাত জিম্মি ছিল। তারা আমাদের তাদের হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। সরকার পতনের পর এই খাতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপিপন্থিরা। ফলে পরিবহনে চাঁদাবাজি কিছুটা কমলেও পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। সমিতির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে; তার সুফলও মিলছে না। ব্যাপক সংস্কার ছাড়া আসলে পরিবহন খাতের কোনো উন্নতি হবে না, কোনও সুফলও পাওয়া যাবে না।

রাজধানীর মিরপুর থেকে প্রতিদিন মতিঝিল অফিসে আসেন মেহেদী জামান। চলাচল ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এমন লক্কড়-ঝক্কড় বাস রাস্তায় যাতে চলতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব তো পুলিশের। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে কিছু বলে না, তাই এরা আমাদের কাছে থেকে ভাড়া ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু সেবা দিচ্ছে না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, রাজধানীতে চলাচলকারী ৭৪ কোম্পানির মধ্যে ৩৬ কোম্পানির গাড়ি সড়কে চলাচলের অযোগ্য। এরই মধ্যে ২১ বার চিঠি দিয়েও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। তাই মেরামত না করে সড়কে গাড়ি নামালে কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি মালিক সমিতির। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস ও ট্রাক চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পর সংস্থাটি একটি তালিকা করেছে। সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭টি। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। বাসের ভাড়া নির্ধারণ করার সময় ধরে নেয়া হয় একটি বাস সর্বোচ্চ ১০ বছর চলাচল করবে। এ সময়সীমার মধ্যেই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর পর বাস আর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না ধরে নিয়েই যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিকরা নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুণের বেশি বাস চালান।