পর্যটন শিল্পে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২, ১২:২৬ রাত

ফাইল ফটো
দেশে পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেই। ফলে পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয়ের সুযোগ হাত ছাড়া হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে পর্যটন শিল্পকে ঢেলে সাজানোর নানা কথা শোনা গেলেও এবং দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হলে বাস্তবে পর্যটন শিল্প অন্যদেশের তুলনায় বহু পেছনের কাতারে রয়ে গেছে। অথচ আমাদের দেশে ট্যুরিস্টদের টানার মতো বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে।
বলা চলে যেসব দেশে দর্শনীয় স্থানের প্রাচুর্য নেই, সেসব দেশ পরিকল্পনা করে ট্যুরিস্ট টানার উদ্যোগ নেওয়ায়, তারা এগিয়ে রয়েছে। পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয় করছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন এ থেকে পেছনে আছে, তা নিয়েই প্রশ্ন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কক্সবাজারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত, প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার কুয়াকাটা, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ, চা-বাগান, নদী, পাহাড়, হাওর, পুরাকীর্তিসহ নানা আকর্ষণ আছে বিদেশি পর্যটকদের জন্য। শুধু বিদেশি পর্যটকদের জন্যই আকর্ষণীয় নয়, দেশি মানুষজনও এসব স্থানে ঘুরতে উৎসাহী।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বিদেশিদের চেয়ে দেশের মানুষ ভিড় করে। দেশি পর্যটকদের ভিড়ে এমনও হয়, যেন সমুদ্র সৈকতে পা রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। বিদেশি পর্যটকদের টানার জন্য সরকারের পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে ঝক্কিঝামেলা নেই। কিন্তু এরপরও পর্যটনখাতে এর প্রভাব পড়ছে না। না পড়ার কারণ হিসেবে বলা যায়, পর্যটন এলাকাকে যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা দরকার এবং পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য সু-ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করা, এগুলোর বেশ অভাব রয়েছে। অবশ্য কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্র দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র, ট্যুরিস্টদের থাকার সুব্যবস্থায় এখানে উন্নতমানের বেশ কয়েকটি হোটেল তৈরি করা হয়েছে। তবে এগুলো পর্যাপ্ত নয়।
দেশের পর্যটন শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলায় যতটা ঢাকঢোল পেটানো হয়েছে, তাতে ঢাকঢোল পেটানোই সার। কার্যত একে আকর্ষণীয় করে তোলা সমন্বিত পরিকল্পনায় ঘাটতি ব্যাপক। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন শিল্পে আমাদের পিছিয়ে থাকাটাই এর প্রমাণ।
দেখা যাচ্ছে- বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে একেবারেই পেছনের সারিতে বাংলাদেশের অবস্থান, ১১০তম। ২০১৯ সালে ছিল ১১৩তম।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল বলছে, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন খাত যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও পর্যটনশিল্প নবজাতক পর্যায়ে রয়ে গেছে। দেশের জিডিপিতে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের অবদান ২.২ শতাংশ। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান ১.৮ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও পর্যটনে অনেকটা এগিয়ে নেপাল। দেশটির জিডিপিতে এই খাতের অবদান ৯ শতাংশ।
এই যে অবস্থা এ থেকে উত্তরণের উপায় হলো পর্যটন শিল্পখাতের উন্নতি করার লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা। আশ্চর্য হলেও সত্য এবং অনেকেই ভেবে অবাক হতে পারেন, আমাদের পর্যটন শিল্পকে যথাযথভাবে বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে গড়ে তোলায় এত ঘটতি, এত মনোযোগের অভাব, সর্বোপরি, দায়িত্বশীলদের অবহেলা, তারপরও করোনা মহামারির ২০১৯ সালের আগে দেশে ৩ কোটি ২৩ লাখ পর্যটক এসেছে। অন্য দিকে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে মহামারির প্রভাবে দেশের পর্যটন খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এই অংক থেকে অনুমান করা যায়, পর্যটন খাত হেলাফেলা করার জিনিস নয়। অনেকের দেশের আয়ের প্রধান উৎস তাদের পর্যটন খাত। আমাদের পর্যটন শিল্প নিয়ে মহাপরিকল্পনা করা হলে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে বিপুল অর্থ আয় হবে এ থেকে।
দেশের পর্যটন শিল্পকে ভালো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেক কথা হলো- আমাদের যথেষ্ট পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে, কিন্তু আমরা বিশ্বের কাছে সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না। এ দায় সর্বদা সরকারের ও ট্যুরিজম বোর্ডের। যারা বিদেশি দূতাবাসগুলোতে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেন, সেখানেও আমাদের পর্যটন সংক্রান্ত কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সম্ভাবনাময় বাজার যেমন-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইংল্যান্ড, চীনে আমাদের প্রচারণা বাড়াতে হবে।
সরকারের আন্তরিকতার অভাব, পৃথক ও শক্তিশালী মন্ত্রণালয় না থাকা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, পর্যটন ব্যবস্থাপনার অভাব, পর্যটন আইনের অভাব, অর্থের অভাব, পর্যটন-সম্পদ চিহ্নিত না করা, গবেষণা না করা, পর্যটন তথ্যভাণ্ডার না থাকা, শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত না করা, দায়িত্বশীল পর্যটন নিশ্চিত না করা, ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ঐক্য না থাকা পর্যটনে পিছিয়ে পড়ার কারণ।
এই মুহূর্তে প্রধান সংকট সরকারি মহলের সমন্বয়হীনতা। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, নৌপরিবহন, বন ও পরিবেশ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতাই এই মুহূর্তে বড় সংকট। এর পরও দেশে পর্যটনে যা কিছু দৃশ্যমান, তা বেসরকারি খাত থেকেই হয়েছে। দেশের হোটেলগুলোর এখনো সঠিক স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা যায়নি। অনেকে টু স্টার মানের না হলেও ফাইভ স্টার হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটকদের আরো ভালো সেবা দেওয়ার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, যেগুলো অন্যান্য দেশে আছে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা মনে করি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পরামর্শ বক্তব্য সরকারের দায়িত্বশীলদের কানে তোলা উচিত। বিশাল অর্থের উৎস যেহেতু এ মাধ্যম, ফলে একে এগিয়ে নিতে এদের পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে কতটা পর্যটন কেন্দ্র আকর্ষণীয় হিসেবে দ্রুত গড়ে তোলা যায়, তার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের বৈচিত্রপূর্ণ দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এই পর্যটন সম্পদ থাকার পরেও বিদেশি পর্যটকদের আমরা টেনে আনতে পারছি না। এ ব্যর্থতা দূর করে কাজে নেমে পড়ার এখনি সময়। পর্যটন খাতকে নিয়ে যে সমন্বয়হীনতা আছে তাও দূর করতে হবে। সমন্বয়হীনতা এ শিল্পের বিকাশের জন্য বড় বাধা।
দৈনিক সরোবর/এমকে