ঢাকা, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

আয়নাঘর: স্বাভাবিক জীবনের আলো কেড়ে নিয়েছে

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৫, ০৮:৩০ রাত  

সেদিনের কথা ভুলতে পারেন না মুরাদ।২০১৯ সাল ৯ অক্টোবর। সেদিন বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরছিলেন মুরাদ মেহেদী। হঠাৎই একটি জিপ থেকে সাত-আটজন লোক নেমে তাকে পেছন থেকে বন্দুক তাক করে, সঙ্গে সঙ্গে তার ফোনটি নিয়ে নেয়। 

‘কী করব—বুঝতে পারছিলাম না। পরে তারা আমাকে বাসায় নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনও নিয়ে নেয়। বাবা ছিলেন স্ট্রোকের রোগী। তারা আমার পরিবারের ফোনও নিয়ে নেয়। আমার অপরাধ ছিল, কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে মোদীকে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী) নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে,’-বলছিলেন মুরাদ। কথা বলার সময় বারবার পানি পান করে দম নিচ্ছিলেন তিনি।

মুরাদকে নেওয়া হয়েছিল গোপন বন্দিশালা হিসেবে পরিচিত আয়নাঘরে। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে এমন অনেক বন্দিশালা ছিল। এগুলো নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হতো। গুম থেকে ফিরে আসা অনেকেই এমন গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেলের (নির্যাতনকেন্দ্র) অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। বাংলানিউজ এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদেরই একজন মুরাদ। মুরাদ বুঝতে পারছিলেন না—তাকে কারা, কেন ধরে নিয়েছিল। পরে ১২ অক্টোবর তাকে নিয়েই অভিযান চালানো হয় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার জামিয়া সৈয়দ ফজলুল করিম মাদরাসায়। সেখানে জানতে পারেন, তিনি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে বন্দি। অভিযানে সেই মাদরাসার অধ্যক্ষকেও তুলে নেওয়া হয়।

এরপর ১৩ অক্টোবর তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ধারায় দায়ের করা মামলায় আদালতে তোলা হয়। আদালতের রায়ে মুরাদের ১৫ বছরের সাজা হয়। ছেলের এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেননি বাবা। মুরাদ বলছিলেন, তার বাবা মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন,‘বাবার লাশটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি।’ 
পরে ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান।

আয়না ঘরের দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বারবার মুষড়ে পড়ছিলেন মুরাদ। 

‘যখনই ঘুমে চোখ লেগে আসত, তখনই ডেকে নিয়ে যেত। সেখানে ঠিকমতো ঘুমাতে দিত না। পাশেই আরেকজন ছিল, তাকেও বিনা অপরাধে তুলে নিয়ে আসা হয়। যখনই তিনি প্রস্রাব করতে যেতেন, তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। তার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে পুঁজ হয়ে পচন ধরে। এই বিভীষিকা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’ -বলছিলেন মুরাদ।

চারদিকে নির্যাতনের চিত্র মুরাদকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। নির্যাতনের কথা সইতে পারছিলেন না তিনি। 
‘বারবারই মনে হতো, এত নির্যাতনের চেয়ে আমাকে এনকাউন্টার দিক। এক ভুক্তভোগী নির্যাতন সইতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন,’-বলছিলেন মুরাদ।

পেশায় কৃষিবিদ ফসিউল আলম ভূইয়া। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর তাকেও একই কায়দায় রাজধানীর উত্তরা থেকে তুলে নিয়ে যায় র‌্যাব। 

তিনি বলেন, আমাকে কানে ক্লিপ পরিয়ে ১৫-২০ সেকেন্ড ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় প্রথম দিনই।

তার অপরাধ ছিল সরকারের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া।

ফসিউল বলেন, আমি ১৯ দিন গুমের প্রতিটি ঘণ্টা যে কষ্ট করেছি, তা বলার মতো নয়। কেউ যেন এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার না হয়। আজও আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। এখনো আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়।

ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আরমান আয়নাঘরে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। সূর্যের আলো দেখা থেকেই বঞ্চিত ছিলেন আট বছর। 

তিনি শুনিয়েছেন আয়নাঘরে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া গা শিউরে ওঠা গল্প। তার ভাষায়, মনে হচ্ছিল জীবন্ত অবস্থায় কবরে ছিলাম, কখনো ভাবিনি বেঁচে ফিরব।

২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুর ডিওএইচএইস থেকে আরমানকে তুলে নিয়ে রাখা হয় হাসিনা সরকারের গোপন বন্দিশালায়। 

তিনি বলছিলেন, ২৪ ঘণ্টা চোখে কাপড় বাঁধা থাকত। হাতও বেঁধে রাখা হতো। দিনের বলো হাত সামনে বাঁধা হতো। আর রাতে পেছনে। চারিদিক থেকে শুধু চিৎকার ভেসে আসত। মনে হতো যেন কবরে আছি।বেশ অসহ্য লাগত। মনে হতো, এর চেয়ে মৃত্যু ভালো। ইবাদত করার সময় জানতে সেখানে একটি ঘড়ি চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটিও পাইনি।

আরমান শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তিনি দিন-রাতের ব্যবধান পর্যন্ত বুঝতে পারতেন না। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার শ্যামলী থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমাকে। পরে গত বছরের আগস্টে তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই সময়টা তিনি ছিলেন আয়নাঘরে বন্দি।

বন্দি দশা থেকে ফিরে মাইকেল চাকমা জানতে পারেন, পুত্রশোক বুকে নিয়ে তার বৃদ্ধ পিতা মারা গেছেন। মাইকেল আর জীবিত নেই ধরে নিয়ে রীতি মেনে তার শেষকৃত্যও করেছিল পরিবার। ‘আমাকে শারীরিক নির্যাতন করেনি। কিন্তু মানসিক নির্যাতন এমনভাবে করেছে, যেভাবে বেঁচে থাকা যায় না। আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে কোনো পশুকেও রাখা সম্ভব নয়। ভাবিনি বেঁচে ফিরব। সেখানে আরও অনেক লোক ছিল। জানি না তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে,’- এক বুক হতাশা নিয়ে এসব কথা বলছিলেন মাইকেল চাকমা।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকার তিনটি গোপন বন্দিশালা বা আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ব্রিফিংয়ে জানান, সারা দেশে আয়নাঘরের সংখ্যা ৭০০ থেকে ৮০০–এর মতো হতে পারে। এটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ রকম আয়নাঘর ছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকেও তুলে নিয়ে নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদের যে কক্ষগুলোতে রাখা হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে সেগুলো শনাক্ত করেন তারা।

প্রথমবার আয়নাঘরের বিষয়টি সামনে আসে ২০২২ সালের আগস্টে, একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। তখন বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালার কথা প্রকাশ করেন দু’জন ভুক্তভোগী। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বহু মানুষ গুমের শিকার হন। গুম থেকে ফিরে আসা অনেকেরই ভাষ্য, তাদের আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। অনেকে আবার গুম থেকে ফিরে আসেননি। তাদের পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে সব সময়ই সরব থেকেছেন। বিগত সরকারের সময়ে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠী এ নিয়ে আওয়াজ তুললেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর আয়নাঘর নিয়ে আলোচনার বিষয়টি অনেকটাই উন্মুক্ত হয়। তখন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা।

গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গুম কমিশন গঠন করে। এই কমিশন গত ১৪ বছরে যত গুম হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করছে। কমিশন বলছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশি গুমের শিকার হয়েছে।

মার্চের শুরুতে গুম কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, এ পর্যন্ত এক হাজার ৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে এক হাজার অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। ২৮০ জন অভিযোগকারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪৫ জন সদস্যের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া গুমের শিকার ৩৩০ জনের বর্তমান অবস্থা অনুসন্ধান চলছে।

গত বছরের নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ৪০০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানে ১৭২টি ঘটনায় র্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ৩৭টিতে।  

তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সম্পৃক্ততা ছিল ৫৫টিতে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৬টিতে এবং পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ২৫টিতে। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট কোনো বাহিনীর পরিচয় না দিয়ে প্রশাসনের লোক বা সাদাপোশাক পরিহিত অবস্থায় থেকে কাউকে তুলে নিয়েছে, এমন ৬৮টি ঘটনা পাওয়া গেছে।

একই সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব পরিচালিত একটি গোপন বন্দিশালার চিত্র বর্ণনা করেন কমিশনের সদস্য নূর খান। তিনি বলেন, একজন মানুষ গুম থাকা অবস্থায় কীভাবে রোজনামচা লেখেন, বা তার সংকেত লিখে যান, কীভাবে দিন গণনা করেন, এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি।  

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, কত নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে রাখা হতো। এমনও ঘটনা আছে, সাড়ে তিন ফুট বাই চার ফুট—এমন কক্ষের মধ্যেই বন্দির প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা। এর মধ্যেই দিনের পর দিন আটক রাখা হয়েছে।

কমিশনের সভাপতি জানান, তারা বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করছেন। ডিজিএফআই, উত্তরা র‌্যাব-১, র‌্যাব সদর দপ্তর, নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব-১১, মোহাম্মদপুরের র‌্যাব-২, আগারগাঁওয়ে র‌্যাব-২–এ ক্রাইম প্রিভেনশন সেন্টার পরিদর্শন করেছেন তারা। ডিবি কার্যালয়ও এর আগে পরিদর্শন করা হয়েছে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এই ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের মানসিকভাবে শক্ত থাকার সব রকম ব্যবস্থা করা, নিখোঁজদের খুঁজে বের করা এবং জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া।  

যে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ বছর পর ভাগ্যক্রমে সরকার পতনের পর (আয়নাঘর থেকে) জীবিত ফিরেছেন, তাদের এখন অনেকরকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক জটিলতা ফেস করতে হবে। নানাভাবে তাদের স্বাভাবিক জীবনের আলো কেড়ে নিয়েছে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার। বিশেষ করে মানসিকভাবে তারা অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গেছেন, এতটাই তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। সরকারের উচিত এসব মানুষের পাশে থাকা। সূত্র:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দৈনিক সরোবর/ইএইচপি