ঢাকা, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

বর্তমান সংকটে সাশ্রয়ী নীতিই প্রয়োজন

সম্পাদকের কলম

 প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২২, ১২:০৮ রাত  

ফাইল ফটো

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে শতভাগ বিদ্যুায়নের অধীনে আনতে সক্ষম হয়েছে। এমন অবস্থায় দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলটি এই যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগ নিয়েছে যখন দেশে চলছে লোডশেডিং ঠিক তখনই। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট প্রকট হওয়ায় বহু দেশ বিদ্যুতে সাশ্রয়ী হয়ে জ্বালানি সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

ইউক্রেন যুদ্ধই মূলত জ্বালানি সংকট টেনে এনেছে। এ থেকে ইউরোপসহ বিশ্বের বহু দেশ জ্বালানি তেলের সংকটে পড়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়া সেনা অভিযান চালানোর কারণে রাশিয়ার ওপর আমেরিকাসহ ইউরোপের দেশগুলো লাগাতার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এতে জ্বালানি সংকটে বৈশ্বিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।

বিএনপি বর্তমান সরকারের গৃহীত বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কারণ কী শুধুই দেশে চলমান লোডশেডিং? লোডশেডিং শুরুর আগে তো দলটি এই যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। তাহলে কি নিশ্চিত করে বলা যায়, লোডশেডিং বিএনপির জন্য যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগ এনে দিয়েছে?

প্রশ্ন হলো দেশ শতভাগ বিদ্যুায়নের অধীনে আসায় কি ক্ষতি হলো না লাভ হলো? মোটাদাগের এই প্রশ্ন ওঠার কারণ হলো বর্তমান সরকার বিএনপির বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করে কোথায় মহাভারত অশুদ্ধ করেছে? বিএনপির কথায় মনে হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা থাকার সময় ১০০ মেগাওয়ার্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করেছিলো। এদের ক্ষমতায় থাকার সময়ে পুরো দেশ অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলো। বিদ্যুতের অভাবে শিল্প-কারখানার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প মুখ থুবরে পড়েছিলো। তখন চীন থেকে ছোট-বড় জেনারেটর আনার হিড়িক পড়ে। এই বিপুল অংকের টাকা দিয়ে জেনারেটর এনে কাজ চালানোর চেষ্টা করে ছোট ছোট উদ্যোক্তারা।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদনের ব্যাঘাতসহ জনজীবন কতটা দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলো, তা বোধ করি সবার মনে থাকার কথা। বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় এসে তড়িৎ গতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করেন। দেশে লোডশেডিং কমতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুইকরেন্টাল অর্থ্যাৎ দ্রুততম সময়ের মধ্যে কিভাবে মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়, এ চিন্তা থেকে স্বল্প মেয়াদে ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন। এতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। বিএনপি ঘোষণা করেছে ক্ষমতায় গেলে কুইক রেন্টাল চুক্তি বাতিল করবে।

এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন এবং কুইক রেন্টাল কোম্পানির চুক্তি বাতিল করবে তারা।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, আমাদের আশার বাণী হচ্ছে, আমরা বিদ্যুতের এই সমস্যার সমাধান করবো। আমরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করবো। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে।

এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সামিট গ্রুপ, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, এরদা পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ক্যাট, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি- এই কোম্পানিগুলো কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এ ছিল কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাট।

ভারত আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ এনে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। বিএনপি এর ঘোর বিরোধিতা করছে। কারণ কি ? ভারত থেকে বিদ্যুৎ এনে সরকার সঠিক কাজটি করেনি বলেই কি? আচ্ছা মির্জা ফখরুল এ ব্যাপারে কি বলেছেন, দেখুন- বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

গ্যাস-সংকটের কারণে এখনই প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী চার বছরে আরো ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক গুণ বেড়ে যাবে। আর বসিয়ে বসিয়ে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ অর্থ জনগণের অর্থ। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনায় বিএনপি ভালো চোখে দেখছে না। কিন্তু দুর্নীতির কোনো অভিযোগ তোলেনি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার বিরোধিতার সঙ্গে বিএনপি কোনো বার্তা ভারতকে দিতে চায় কি-না তা বিবেচনায় নিতে হবে।

এবার আসা যাক পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বিএনপির অভিযোগ খতিয়ে দেখা যাক। কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা এটি উদ্বোধন করেছেন। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে এ বিদ্যুতের কারণ বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়বে না। পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হু হু করে শিল্পকারখানা তৈরি হবে। তখন অনেক বিদ্যুৎ লাগবে। সরকার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছে। এখন বিএনপি এর বিরুদ্ধে কথা বলছে।

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে মির্জা ফখরুল কি বলেন, দেখুন-পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ না দিলেও এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে চীনের ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুৎ না কিনেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন, এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি তথা মির্জা ফখরুলের কথার সারাংশ বুঝতে কারোর বাকি থাকবে না বলে আমরা মনে করি। গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। এতে সারাদেশ শতভাগ বিদ্যুায়নের অধীনে এসেছে। আর এতে বিএনপির-জামায়াতের জোট সরকারের সময়ে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের চরম ব্যর্থতা দেশবাসীকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে।

বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্যকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লুটপাট-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ এনে সরকারের এই সাফল্যকে হেয় করে তোলার যে নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয় দেওয়া হলো, এতে সাধারণ একটি শিশু বুঝতে পারবে এ দলটির মাথা স্থূলকায়, বুদ্ধি নেহায়েত কম। বঙ্গবন্ধুকন্যার সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু বিএনপি যেভাবে দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরছে, তাতে দলটির জামানায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যর্থতাকে বারবার সবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনিয়ম-দুর্নীতি ধুয়োতুলে সরকারকে ঘায়েল করার এই নীতি বিএনপি কোত্থোকে আমদানি করেছে আমরা জানি না। আমরা আশা করবো- সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটি সঠিকভাবে কথা বলুক, কিন্তু নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সরকারকে দোষারোপ, এটা মানুষ বুঝতে সক্ষম।

দৈনিক সরোবর/এমকে