অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অটুট থাকতে হবে
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২২, ১০:১৩ দুপুর

ফাইল ফটো
জ্বালানি সংকটে আটটি উন্নয়নশীল মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো একে অপরের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। শুধু জ্বালানিই নয়, বহুদিক দিয়ে পরস্পর উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে কাজে এগিয়ে আসতে পারে। তেমন সুযোগ রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে নতুন এক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এই যুদ্ধ জ্বালানি সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে ডি-৮ এর সম্মেলন অনুষ্ঠানের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ডি-৮ সম্মেলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে; তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। বুধবার (২৭ জুলাই) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ডি-৮ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের হাইব্রিড বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া ও তুরস্কর ডি-৮ এর অনুর্ভুক্ত দেশ। এই দেশগুলোর ইরান ও নাইজেরিয়া তেল সমৃদ্ধ দেশ। বিশেষ করে বিশ্বের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ইরান শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে উন্নতির রোল মডেলে পরিণত করেছেন। ফলে ডি-৮ এর অন্তর্ভুক্ত অন্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে নানা দিকে।
ডি-৮ সম্মেলনে জ্বালানির যে বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে তাতে জোটভুক্ত দেশগুলো বর্তমান জ্বালানি সংকট থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পেতে পারে। এতে ইরানের সহযোগিতার হাতটি আমরা প্রসারিত দেখতে চাই। তবে ইরানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাতে জ্বালানি সংকট দূর করতে ভূমিকা নিতে পারবে কি-না স্পষ্ট নয়। ডি-৮ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটভুক্ত দেশগুলোর জন্য কয়েকটি প্রস্তাব রেখেছেন। গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ডি-৮ এখন সমন্বয় তৈরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ করতে প্রস্তুত। রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতের অর্থপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে। আমাদের অপার সম্ভাবনা যদি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়, তাহলে একটি অর্থনৈতিক ব্লক হিসেবে শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
ডি-৮ সম্মেলন আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। বাধাগুলো উদারীকরণ করবে এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে উদ্দীপিত করবে। যে সময় আমরা সবাই কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপর্যস্ত ছিলাম, সে সময় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে বিপদে ঠেলে দিয়েছে। সংঘাত এবং পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা খাদ্য, সার, শক্তি ও বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি বহন করছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অধিকাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমাদের সবার উচিত সাহসের সঙ্গে এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসা। কোভিড-১৯ মহামারি সংঘাত, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্ব কঠিন সময় অতিক্রম করছে। কাজেই, শক্তিশালী বহুপাক্ষিক সহযোগিতার প্রয়োজন এবং বৈশ্বিক সংহতি এই লক্ষ্যে আগের চেয়ে আরো বেশি মনোযোগের দাবি রাখে।
ডি-৮ দেশ ছয়টি বঞ্চিত এলাকায় সহযোগিতা করছে। এটির আগামী দশকের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ফোকাস ক্ষেত্র তৈরি করা উচিত। পিটিএ বাস্তবায়ন একটি সফল ডি-৮-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। কারণ, দেশগুলোর বড় দেশীয় বাজার এবং একটি সম্মিলিত বাজার রয়েছে, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। আন্তঃডি-৮ বাণিজ্য আমাদের ব্যবসার সম্ভাবনা এবং সুযোগগুলোকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে। আগামী দশকে ১২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে আন্তঃডি-৮ বাণিজ্য দ্বিগুণ করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সদস্য দেশগুলোর বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা দিতে প্রস্তুত। আমরা যদি এখনই প্রক্রিয়া শুরু করি, তাহলে আগামী দশকের মধ্যে আমাদের একটি শক্তিশালী ডি-৮ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। আইসিটি এমন একটি ক্ষেত্র যার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডি-৮ দেশের যুবকদের শক্তিশালী কর্মশক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ৪০ বছরের নিচে এবং আমাদের সাড়ে ৬ লাখ নিবন্ধিত আইটি ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা আইটিভিত্তিক শিল্প তৈরি করতে এবং তরুণদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে পারি। খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ডি-৮-এর বৈচিত্র্যময় কৃষি উৎপাদনে মনোনিবেশ করা উচিত। বাংলাদেশ তার সেরা অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতা অন্যান্য ডি-৮ সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ভাগ করে নিতে প্রস্তুত। আগামী দশকের মধ্যে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের কৃষি উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সমস্ত ডি-৮ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প শক্তির উৎসগুলোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিষয়টি ডি-৮ এর সদস্যদেশগুলোর সামনে তুলে ধরেছেন, আমরা আশা করবো, দেশগুলো গভীরভাবে বিবেচনায় নেবে। ডি-৮ কে বেশিমাত্রায় অর্থবহ করে তুলতে হলে পরস্পরের ঘনিষ্টতাও বাড়িয়ে তোলা উচিত। বাংলাদেশের জন্য আনন্দের খবর হলো, বাংলাদেশ আবারও এক বছরের জন্য ডি-৮-এর চেয়ারের দায়িত্ব পেয়েছে। আগামী এক বছর ডি-৮ চেয়ারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিলো মিসরের। তবে তারা এবার কপ-২৭-এর দায়িত্বে রয়েছে। তারা সেটা নিয়ে ব্যস্ত। এজন্য মিসর ও সব সদস্য দেশের অনুরোধে বাংলাদেশ আবার চেয়ারের দায়িত্ব পেয়েছে। এদিকে বলা প্রয়োজন, ইউক্রেন যুদ্ধে যে জটিল পরিস্থিতি বিশ্বে তৈরি হয়েছে। এতে নানাবিধ সংকট এসে হাজির হচ্ছে। তার মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়টি মুখ্য। দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ এ অবস্থায় বাংলাদেশ নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশও করেছেন। তবে বিশ্বের শীর্ষ ক্রেডিট রেটি সংস্থা মুডি’স বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। তবুও খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কম।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। মুডি’স এর একজন সার্বভৌম বিশ্লেষক ক্যামিল চৌটার্ড বলেন, যদিও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্রতি কমেছে- উচ্চ স্তর থেকে। তারপরও দেশটির বাহ্যিক দুর্বলতার সূচকে ঝুঁকি কম।
পরিশেষে বলা জরুরি, ডি-৮ সম্মেলনে জ্বালানি সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে জোটভুক্ত দেশগুলো। জোটের সদস্য দেশগুলোর জ্বালানি মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু কখন বৈঠক হবে তার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। আশা করা যায় অচিরেই হবে। জোটকে কার্যকর করতে হলে বর্তমান যে ক্রান্তিকাল যাচ্ছে জ্বালানি নিয়ে, এ অবস্থায় জোটভুক্ত দেশগুলো সংকট উত্তারণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
দৈনিক সরোবর/এমকে