ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

বাজেটে সংকোচন

উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীর গতি 

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: জানুয়ারী ০৫, ২০২৫, ০৮:৪১ রাত  

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাদ দেওয়ায় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে বড় ধরনের সংকোচনের সম্ভাবনা রয়েছে। ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক উন্নয়ন প্রকল্পকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে তা ছেঁটে ছোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতি বছর মার্চে বাজেট সংশোধন করলেও এবার কিছুটা আগেভাগে সেটি করতে চায় বর্তমান সরকার। রাজস্ব আদায়ের গতি আমলে নিয়ে আগামী মাসে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বাজেট সংশোধন করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকাকে। এক্ষেত্রে রাজস্ব বাজেট কমানো খুব একটা সম্ভব হবে না। ফলে উন্নয়ন বাজেট কমিয়ে বাজেট সংশোধন করতে হবে। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একনেকের সভায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে নেওয়া অনেক উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় অনুযায়ী ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। চলতি অর্থবছরের চার মাসে রেকর্ড সর্বনিম্ন ৮ শতাংশ উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে। এই নিম্ন বাস্তবায়ন বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তাদের ক্ষেত্রে এ হার ১২-১৩ শতাংশ। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি ধীর রয়েছে। তা গত পাঁচ বছরের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সর্বনিম্ন বাস্তবায়নের হার।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় উন্নয়ন বাজেট ছোট হবে। আগামী মাসে ফেব্রুয়ারিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত নিয়ন্ত্রণমুখী বাজেট দেয়া হবে। সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমানো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প অনুমোদনে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার জানিয়ে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি এখনো সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসছে না। এটা কমিয়ে আনতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়ছে; এটা খুব ভালো খবর আমাদের জন্য।  

চলতি অর্থবছরের চার মাসে রেকর্ড সর্বনিম্ন ৮ শতাংশ উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন এবং সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের হার ১৩ শতাংশ

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ শুরু করেছে। অর্থ বিভাগ বলেছে, কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাইতে পারবে না এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও এদের অধীন বিভিন্ন দপ্তর স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাকে সংশোধিত বাজেটের প্রাক্কলন সংশোধিত বাজেট অর্থ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন (পরিচালন ও উন্নয়ন) প্রণয়ন শীর্ষক পরিপত্রে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, সরকারের অগ্রাধিকার খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং চলতি অর্থবছরের বাজেট নিয়ন্ত্রমুখী সুষ্ঠু ও সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর মেয়াদে এডিপি বাস্তবায়ন ছিল ১৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পাস করা ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার এডিপির মধ্যে যা মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমইডির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিপির ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ২১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলমান ও নতুন প্রস্তাবিত সব প্রকল্প পর্যালোচনায় বিলম্বের পাশাপাশি অর্থ ছাড়ে ক্রমবর্ধমান বিলম্বকে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আইএমইডি কর্মকর্তারা। এছাড়া আগস্টের শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অনেক ঠিকাদার প্রকল্পগুলো পরিত্যাগ করেছে।

উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেটের আওতায় মোটরযান, জলযান, আকাশযানসহ সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ থাকবে। তবে পরিচালন বাজেটের আওতায় ১০ বছরের বেশি পুরোনো যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে অর্থ ব্যয় করা যাবে। পরিচালন বাজেটের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট স্থাপনা ছাড়া নতুন আবাসিক ভবন, অনাবাসিক ভবন এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে চলমান নির্মাণকাজ ন্যূনতম ৭০ শতাংশ শেষ হয়ে থাকলে অর্থ বিভাগের অনুমোদনক্রমে ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতে পরিচালন বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারের নিজস্ব অর্থে সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ, কর্মশালা ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ থাকবে। তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার অবশ্যই মূল বাজেটে উল্লিখিত মোট ব্যয়সীমার (পরিচালন ও উন্নয়ন) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। উন্নয়ন ব্যয়ের বাজেটের মধ্যে কোনো অর্থ অব্যয়িত থাকবে বলে মনে হলে ওই অর্থ কোনোভাবেই পরিচালন বাজেটে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের জন্য কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বেতন-ভাতা খাতে ব্যয়ের হিসাব প্রণয়নে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রকৃত ব্যয়ের হিসাব বিবেচনায় নিতে হবে। সাধারণভাবে গত দুই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম চার-পাঁচ মাসের প্রকৃত ব্যয়ের ধারার ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন তৈরি করতে হবে। রাজস্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে নতুন প্রাক্কলন তৈরি করতে হবে। চলতি অর্থবছরে অর্থ বিভাগের অপ্রত্যাশিত ব্যয় ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকলে সংশোধিত বাজেটে তা উল্লেখ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নগতির কথা স্বীকার করে বলেন, সরকার পরিবর্তনের কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জরুরি সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি বলেন, সংশোধিত বাজেট ও সংশোধিত এডিপির পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সর্বোপরি যেসব প্রকল্প রাখতে চায় সেগুলো শেষ করার জন্য আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা করতে পারবে। কর্মসংস্থান না বাড়ালে মানুষের ভোগান্তি কমবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বেসরকারি খাতকে তাদের নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপ না থাকলে দেশ অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুরু হওয়া বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। 

দৈনিক সরোববর/কেএমএএ