বিপাকে উদ্যোক্তারা
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুদহার বেড়েছে
প্রকাশিত: জুলাই ০১, ২০২৪, ০৬:৫৪ বিকাল

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। তা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেশি। এর পাশাপাশি লাগামহীনভাবে বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্য ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সুদের হার বাড়ানো। কিন্তু সেটি করেও অর্থাৎ সুদহার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়াই রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার ব্যাংক ঋণ বাড়ালে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যায়। এটি মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণখেলাপির কারণে তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের ব্যাংক খাত। এমন অবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হলে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি কমবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া হলে সেটি টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুদ হার আরও বাড়ানো হয়েছে। তা দশমিক ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে সব ধরনের ঋণের সুদ ওই হারে বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে আমানতের সুদ হারও। ঋণের সুদ হার বাড়ার কারণে ব্যবসা খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে পণ্যের দাম। ফলে একদিকে মূল্যস্ফীতিতে চাপ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন ভোক্তা। এতে পণ্য বিক্রি কমে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন দেশের উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দায় এমনিতেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে দফায় দফায় ঋণের সুদ হার বাড়ানোর কারণে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়ছেন।
ব্যবসায় খরচ বাড়ছে আর বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে চাপ তৈরি হচ্ছে মূল্যস্ফীতিতে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। বিদায়ী মে মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা তার আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সরকার নানামুখী প্রদক্ষেপ নিলেও তা ৯ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এত বিশাল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনাকে অসম্ভব মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ কম। সরকারের চাপে সময়মতো সঠিক নীতি নেয়া যায়নি। এ কারণে সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। তবে ব্যাংকঋণের সুদহার ইতিমধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তাই এখন নীতি সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। তবে সবকিছু নির্ধারণ করবে মুদ্রানীতি কমিটি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ঘাটতি পূরণে সরকারকে ব্যাংক নির্ভর হতে হচ্ছে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়; আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
দেশে মার্কিন ডলারের পাশাপাশি স্থানীয় টাকারও সংকট চলছে। বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতায় রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এছাড়া ব্যাংক খাতও নিয়ন্ত্রণহীন। মোটা দাগে এসবই হচ্ছে এখন দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তারা বছরে দুবার মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরে নীতি সুদের হার দুই দফা বাড়িয়েছে। সুদহারের সীমা তুলে দেয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকঋণের সুদে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদের হার বাজারভিত্তিক রেখেই মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। ডলারের সংকটও অনেকটা কমে এসেছে। কোনো অবস্থাতেই আর টাকা ছাপানোর দিকে যাওয়া যাবে না। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। তারা টাকা ছাপিয়ে সংকটে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকেও ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না।
প্রথম দফায় গত জানুয়ারিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয় ও গত মে মাসে তা ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি কাজ করছে না। ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সর্বশেষ মে মাসে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের মে মাসে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়েছিল; সেটি কিনতে এ বছরের মে মাসে খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। যা আগের মাসে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। এপ্রিলে তা ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ছিল।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ