ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উন্নত করার সুযোগ এনেছে নির্বাচন

সরোবর প্রতিবেদক  

 প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২২, ২০২৩, ০৮:৪৯ রাত  

আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য তার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ভয়ঙ্কর অবস্থা এবং মানবাধিকারের রেকর্ডকে উন্নত করার একটি অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশে বড় হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উঠে এসেছে দেশটি। কিন্তু বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে গণমাধ্যম কর্মীদের নির্বিচারে আটক, দীর্ঘস্থায়ী আইনি হয়রানি ও নজরদারি করছে, এমনকি তাদের কাজের জন্য প্রতিশোধও নিচ্ছে। গণমাধ্যম কর্মীদের হত্যা, অপহরণ এবং সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রায়ই দায় মুক্তি পেয়ে যান অপরাধী। 

সাংবাদিকদের প্রতিদিনকার প্রতিবেদনগুলোই তথ্য প্রবাহের প্রাণ। এটি গতিশীল অর্থনীতিকে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু সরকারি ক্র্যাকডাউনের ফলে সাংবাদিকরা এখন চুপ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এতে জনসাধারণ এবং বাজারের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার অধিকারও হুমকিতে পড়েছে। অবাধ তথ্য প্রবাহ সুশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর থেকে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সংঘর্ষ, ব্যালট স্টাফিং, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং ক্ষমতাসীনদের ভোট কেন্দ্র দখলের অনেক রিপোর্ট পাওয়া গেছে। আসন্ন নির্বাচনের আগেও সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সময় বাংলাদেশি পুলিশ গোলা-বারুদ, টিয়ার গ্যাসের শেল এবং স্নাইপার রাইফেলের বড় চালান সংগ্রহ করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজনৈতিক সমাবেশ কভার করার সময় কয়েক ডজন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন, সেই সঙ্গে নির্বাচনী অসদাচরণেরও অভিযোগ উঠেছে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ৫৪টি নিউজ ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়। পাশাপাশি থ্রিজি-ফোরজি ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার মাধ্যমে তথ্য প্রবাহে বাধা দেয় এবং মিডিয়ার কার্যকরভাবে কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস করে। শাসক দলের সদস্যদের শারীরিক হামলা এবং ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া ছাড়াও ব্যালটে অনিয়মের রিপোর্ট করায় সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও তদন্তের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর ফলে তারা ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ করতে বাধ্য হচ্ছেন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুন্ন করার সঙ্গে জড়িতদের জন্য একটি বিশেষ ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন সরকার। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছে, যারা গণমাধ্যমকে তাদের সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধেও এই নীতি কার্যকর হবে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গত মার্চ মাসে গ্রেফতার করা হয়।  প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম ২০২১ সালে কথিত সরকারি দুর্নীতির বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য নির্বিচারে সাত দিনের জন্য আটক ছিলেন। তিনি ঔপনিবেশিক যুগের একটি আইনের অধীনে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন, যাতে দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তার পাসপোর্ট বিচার বিভাগীয় হেফাজতে রয়েছে, তার অবাধে ভ্রমণের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জামিনে মুক্তি পাওয়া শামস এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান নিয়মিতভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অধীনে দায়ের হওয়া মামলার জন্য আদালতে হাজির হন। এটি একটি কঠোর আইন যা অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের স্বাধীন মতপ্র কাশকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে।

ঢাকা-ভিত্তিক ‘সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ’ অনুসারে, ২০১৮ সালে আইনটি চালু হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪০০ টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে।  ডিএসএ তদন্তের মুখোমুখি সাংবাদিকরা নির্যাতন ও নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ করেছে। লেখক মুশতাক আহমেদের জন্য ন্যায়বিচার এখনও অধরা। ২০২১ সালে ডিএসএ’র অধীনে নয় মাসের প্রি-ট্রায়াল ডিটেনশনের সময় তার মৃত্যু হয়। এই আইনের অধীনে নির্বাসিত সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদেরও টার্গেট করা হয়। বিদেশ থেকে যাতে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন না হয়, তা নিশ্চিতের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয় এটিকে।

সরকার গত সেপ্টেম্বর মাসে ডিএসএ বাতিল করে নতুন ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ প্রনয়ণের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ডিএসএ সংক্রান্ত মানবাধিকার রেকর্ডকে ঘিরে উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও বাস্তবে নতুন আইনটি কেবল মিডিয়া এবং সমালোচকদের মধ্যে একইভাবে ভয়ের একটি বিস্তৃত সংস্কৃতি তৈরি করতে ব্যবহৃত ডিএসএ’র দমনমূলক ধারাগুলোকে পুনরায় উপস্থাপন করবে। উপরন্তু, নতুন আইন সত্ত্বেও ডিএসএ’র অধীনে হওয়া মামলাগুলোও প্রত্যাহার করা হবে না। সাংবাদিকতাকে অপরাধীকরণের প্রচেষ্টাকে দৃঢ় করার পরিবর্তে, বাংলাদেশের উচিত গণমাধ্যমের অবাধ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার রক্ষা করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিতকারীদের ওপর হেনস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

গণতন্ত্র এবং টেকসই প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা সরকারগুলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে এমনভাবে অংশীদারিত্ব করা উচিত যাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এর শুরু হতে পারে সহিংসতা এবং হস্তক্ষেপ মুক্ত নির্বাচনী প্রতিবেদনের মাধ্যমে। এটি একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক রিসেটের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ‘জনগণের আস্থা’ তৈরি হবে। তথ্য সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট

দৈনিক সরোবর/এএস