ঢাকা, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

গ্রেনেড হামলা আর যেন না ঘটে

সম্পাদকের কলম

 প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২২, ১১:১০ রাত  

ফাইল ফটো

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করে তাদের রক্তের পিপাসা মেটেনি। জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু ঘাতক দল জাতির পিতার দুই কন্যার প্রাণ সংহার করতে পারে, এজন্য তারা বিদেশেই থেকে যান। ঘাতকেরা জাতির পিতার বংশকে নির্বংশ করার কথা একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলে যায়নি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) প্রাণ সংহারের জন্য ২১ আগস্ট ২০০৪ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় দলীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে মুর্হূমুহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই হামলায় আইভী রহমানসহ ২৪ জন মারা যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আল্লাহতালার অশেষ করুণায় প্রাণে বেঁচে যান।  ২১ এর গ্রেনেড হামলা থেকে একটি বিষয় দিনের মতো স্পষ্ট হয় যে, যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড দিয়ে দিনের আলোয় হামলা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী  লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকেও নৃশংসভাবে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। এই সব বর্বর হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি মানুষকেই হত্যা নয় পাশাপাশি দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতিকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা আরেকটি চরম ঘৃণ্য কাজ। ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবৈধ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যুক্ত ছিলেন, অনুরূপভাবে ২১ আগস্টেও তার পরিবারের জড়িত থাকার ঘটনা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, বিচার ও সাক্ষ্যপ্রমাণে পাওয়া গেছে।

জিয়াউর রহমান যেমন ১৫ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড, তার পুত্র তারেক রহমানও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড। ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে  জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড এবং ২১ এর গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধুকন্যার হত্যাচেষ্টার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে গেছে। স্বাধীনতাবিরোধী ও জাতির পিতার ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে, তার ওপর পাকিস্তানের পতাকা উড়াবার অপচেষ্টা করেছে। ঘাতকদের সেই অপচেষ্টা আজ বন্ধ হয়নি। জাতির পিতার অন্যতম খুনি জিয়াউর রহমানে পুত্র খুনি তারেক রহমানকে ফের ক্ষমতায় আনার নানা অপচেষ্টা দৃশ্যমান। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে।

২১ এর গ্রেনেড হামলাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার যে অপেচেষ্টা বিএনপি করেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া (তখন প্রধানমন্ত্রী) সংসদে দাঁড়িয়ে দম্ভভরে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেই শাড়ির আঁচলের নিজে গ্রেনেড লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য। বেগম জিয়া কতটা অমানবিক যে পুত্র তারেক রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলার জন্য জঙ্গিদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন। যে গ্রেনেড দিয়ে হামলা করা হয় তা যেমন যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তেমনই এগুলো পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিলো।

বিএনপি যে কথাটি বর্তমানে খুব বেশি বেশি উচ্চারণ করে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে। অথচ বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দেশের বিরোধী দলের নেত্রীর জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে মেরে ফেলার নিকৃষ্টতম কাজ করেছে। পাশাপাশি আমরা দেখলাম বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এতিমের টাকা মেরে খাওয়ায়র অপরাধে দণ্ডিত বেগম জিয়াকে মানবিকতা দেখিয়ে খালেদা জিয়াকে নিজের বাসায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। এমন মানবিকগুণ সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর আমরা পাবো কি-না জানি না। ২১ এর গ্রেনেড হামলার চিত্র কতটা ভয়াবহ, বীভৎস ছিলো তা এক মিনিটের জন্য ভাবলে গা শিউরে উঠবে যে কারোর। নানা সংবাদমাধ্যমে সেইদিনের সেই ভয়ংকর ঘটনা প্রকাশ হয়েছে।

আজ তা প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে পাওয়া সেই দিনের ঘটনা পাঠক একটু পড়েননি। সেদিন ২১ আগস্ট ২০০৪, বিকেলে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় দলীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সারাদেশে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষ সেদিন জড়ো হয়েছিল। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে যাওয়ার কথা।

বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজে চেপে বিকেলে ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে আসেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে খোলা ট্রাকই ছিল সেদিনের প্রতিবাদ সভার মঞ্চ। ট্রাকে দাঁড়িয়ে সেদিন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রায় ২ ঘণ্টার মতো বক্তৃতা দেন। পরে ৫টা ০২ মিনিটে সভার প্রধান অতিথি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু করেন। বক্তৃতা করেছিলেন প্রায় ২০ মিনিট, সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট।

‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোতে থাকলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। মুহূর্তেই নারকীয় গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। সে এক ভয়াল অবস্থা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১২টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আওয়ামী লীগ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আইভী রহমানসহ আরো ১১ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে গণমিছিল। কিন্তু মিছিল আর হলো না। গ্রেনেড হামলায় আচমকা আকাশ ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেলো। শরতের বিকেল গ্রেনেড হামলায় প্রকম্পিত হয়ে গেলো। হামলায় চারদিকে ছোটাছুটি, প্রাণভয়ে মানুষজন দিগবিদিক দৌড়াচ্ছেন।

গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ আর বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে আকাশ। আক্রান্ত মানুষের আর্তচিৎকার। থোকা থোকা রক্তস্নাত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ যেন মৃত্যুপুরী। মরণের নৃত্য যেন নেমেছিলো আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে। সেদিন আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই পুরো ঢাকা হয়ে ওঠে এক আতঙ্কের নগরী। নারকীয় সে হামলায় নিহত-আহতদের চিকিৎসায় কোনও সহযোগিতা করেনি জোট সরকার।

এমনকি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড উদ্ধার করা হলেও আলামত নষ্ট করতে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনাস্থলের সকল আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়। হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত। আহতরা যেন চিকিৎসা না পান সেজন্যও উপরের নির্দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল। হামলার পর অগণিত আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে নেওয়া হলেও মূল প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত সমর্থক ড্যাবের ডাক্তাররা সেদিন চিকিৎসা দিতে আসেনি। ফলে আহত বেশিরভাগ নেতাকর্মী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল। এমন ভয়াবহ ঘটনায় বিরোধীদলীয় নেতাসহ ৫ জন এমপি আহত হলেও সরকারের কোনও মন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেননি এবং জোট সরকারের কেউ যায়নি আহতদের দেখতে। বরং ঢাকা শহরে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিডিআর নামিয়ে জনমনে ভীতির সৃষ্টি করা হয়। পরদিন সন্ধ্যার আগেই পোস্টমর্টেম শেষ হলেও নিহতদের লাশ গভীর রাতের আগে স্বজনদের দেওয়া হলো না। গায়েবানা জানাজার পর শোক-মিছিলেও হামলা করলো পুলিশ এবং বিএনপির ক্যাডাররা।

ঘৃণিত গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন, তার সব চেষ্টায়ই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাঁচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। এটি ছিল একেবারে ঠাণ্ডামাথায় হত্যার পরিকল্পনা। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থাসম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই সেদিন শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। গ্রেনেড আক্রমণ ব্যর্থ হলে শেখ হাসিনাকে হত্যার বিকল্প পন্থা হিসেবে বন্দুকধারীদের তৈরি রাখা হয়। আর এই বন্দুকধারীরাই খুব হিসাব কষে নেত্রীর গাড়ির কাঁচে গুলি চালায়। এই গুলি বুলেটপ্রুফ কাঁচ ভেদ করতে ব্যর্থ হলে তারা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

সব শেষে গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় গুলির আঘাতে গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের দুটি চাকা পুরোপুরি পাংচার হয়ে গেলেও চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ধানমন্ডির সুধা সদনে নিয়ে যান। গ্রেনেড হামলার পরপরই শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ঘেরাও করে নামিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে আসেন। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় তাকে ঘেরাও করে রাখা আওয়ামী সভাপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী মাহবুব স্পটেই মারা যান। কোনোক্রমে শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পরপরই গাড়ি চালু করতেই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। কোনোরকমে জীবন নিয়ে তার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদনে ফেরেন শেখ হাসিনা। 

এখনও আমাদের জন্য পরিতাপের বিষয় হলো, আগস্ট মাস বাঙালি জাতির সামনে ফিরে এলে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। অথচ এ মাসজুড়ে বাঙালি জাতির হৃদয়ে চলতে থাকে রক্ত-ক্ষরণ। ২১ এর গ্রেনেড হামলার মামলায় এখনও বেশ কয়েকজন অপরাধী পলাতক রয়েছে। আমরা আশা করবো, দ্রুত তাদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করে আইনের হাতে সপর্দ করা হবে। ২১ এর গ্রেনেড হামলার ঘটনা থেকে বারবার আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যে স্বাধীনতা ও জাতির পিতার ঘাতকরা কখনো যেন বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে না পারে। এদের সঙ্গে যারা যুক্ত হয়ে দেশের মানুষকে নানা বিভ্রান্তির জালে আটকে ফেলার অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করছে, সমূলে সবার শিকড় উপড়ে প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। পুনশ্চ বলা যায়, ২১ এর গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

দৈনিক সরোবর/এমকে