ভোক্তার পকেট কাটছে সিন্ডিকেট
শুল্ক ছাড়েও পণ্যমূল্য কমছে না
প্রকাশিত: মার্চ ০৯, ২০২৪, ০৭:৪৪ বিকাল

বাজারে পণ্যের দাম কমাতে এলসি মার্জিন শিথিল ও আমদানি শুল্ক কমানোসহ একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পাশাপাশি বাজারে বাড়ানো হয়েছে তদারকি। এরপরও কমছে না নিত্যপণ্যের দাম। কারণ প্রতি বছরের মতো এবারও আসন্ন রমজান ঘিরে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অতি মুনাফার ছক তৈরি করেছে।
কারসাজি করে রোজার ৩ মাস আগ থেকেই (গত বছরের ডিসেম্বর) বেশকিছু পণ্যের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চাঁদাবাজি। পণ্যবোঝাই যানবাহন থেকে ঘাটে ঘাটে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা একই বিষয়ে কথা বলছেন। তারা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মূল্যবৃদ্ধির। প্রায় সর্বত্র পণ্যমূল্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তেমন কাজ হচ্ছে না। দাম খুব বেশি কমছে না; উলটো বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্য।
জানা গেছে, বাজার সিন্ডিকেটের ছক অনুযায়ী গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। রোজার আগে এই বৃদ্ধি বিশেষভাবে নজর কেড়েছে সবার। এরপর থেকে সিন্ডিকেটে হাত না দিয়ে পণ্যমূল্য কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। কিন্তু সেগুলো খুব বেশি কাজে আসছে না বলে জানান ক্রেতা ও বিক্রেতারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলেন, প্রতি কেজি ছোলা নভেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে ৩৫ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ১৪০ টাকা কেজির চিনি এখন সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডাল কিনতে ক্রেতার গুনতে হচ্ছে ১৫০ টাকা; যা ১২০ টাকা ছিল। এছাড়া পেঁয়াজের কেজি এখনো ১৪০ টাকা। বাড়তি মাছ-মাংসের দামও। ফলে রোজার আগেই ক্রেতাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এমন অবস্থা চললেও সরকারের একাধিক সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শুধু হাঁকডাকের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। এতে বাজারে ক্রেতাসাধারণ প্রতারিত হচ্ছেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বছরে কয়েক দফায় ভোক্তার পকেট কাটছে; সেই চিহ্নিত সিন্ডিকেট সদস্যরা। তারা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। রোজার পণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে। তদারকিতে শুধুই হাঁকডাক; কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তাই পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বেড়েছে কিনা; তা সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে অসাধুদের আইনের আওতায় এনে ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হবে।
আট পণ্যে আমদানির এলসি মার্জিন ও ৪ পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে নেই এর প্রভাব, উল্টো দাম বাড়ছে
খুচরা বাজারের পণ্যমূল্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রোজার বাকি আর মাত্র এক সপ্তাহ। মুসলমানদের এই ধর্মীয় উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে চায় সরকার। শুল্কছাড় ছাড়াও বাড়ানো হয়েছে বাজার তদারকি। সিন্ডিকেট এবং মজুদদারদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে হুঙ্কার। এরপরও নেই দাম কমার লক্ষণ। উল্টো রমজান যতই এগিয়ে আসছে, ততই লাগামহীনভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের বাজার।
টিসিবির হিসাব বলছে, গেল বছরের তুলনায় এই রোজার আগে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। তবে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে কয়েকটি পণ্যে শুল্ক ছাড় দিয়েছে সরকার। এরপরও সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। শুধু শুল্ক ছাড়ের প্রভাব পড়বে সয়াবিন তেলে। গত ১ মার্চ থেকে কমছে সয়াবিনের দাম। অন্যান্য শুল্ক ছাড় করা পণ্যের দামের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন নেই। বরং দাম বাড়তির দিকে। নতুনভাবে বাজারে বেড়েছে চিনির দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বেশি থাকায় পণ্য কেনা কমিয়েছেন ক্রেতারা। এ বিষয়ে এক ক্রেতা বলেন, বাজারে সবকিছু ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সবার জন্য বাজারের জিনিসপত্র কেনা কঠিন। কিছু মানুষ আছে যারা কিনতে পারে; তবে বেশির ভাগ মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর।
খেজুরে বড় ধরনের শুল্ক ছাড় দিয়েছে সরকার। তবে এখনও বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে রোজায় প্রয়োজনীয় এই পণ্য। উল্টো কেজিতে দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর এক খেজুর বিক্রেতা বলেন, জাম্বুরা নামে এক জাতের খেজুর আছে, এটির এখন দাম এক হাজার ৮০০ টাকা। কয়দিন আগেও ছিল এক হাজার একশ থেকে দুইশ টাকা। মারিয়াম ছিল ছয়শ থেকে সাতশ টাকা কেজি; এখন এক হাজার। সব খেজুরের দাম বেড়েছে।
মাশরুক এতদিন ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ টাকা কেজি। এখন দেড় হাজার বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা আর নভেম্বরে ছিল দাম ছিল ১৮৫ টাকা। অন্যদিকে নভেম্বর থেকে কমতে থাকে গরুর মাংসের দাম। সে সময় প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬০০ টাকা। নির্বাচনের পর দাম কিছুটা বেড়ে ৬০০-৬৫০ টাকা হয়। এরপর মার্চে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকা। এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা ক্রেতা নেই বললেই চলে। বিক্রিও কমেছে। আমাদের দোকানে যে খরচ হয়; সেটি তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সবকিছুর দাম বাড়তি। এখানে তো আমাদের কোনো হাত নেই। বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে; তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আরেক দোকানি বলেন, কাবলি ও ছোলা আনতে গিয়েছিলাম পাইকাররা দেয়নি বলেছে, কয়দিন পরে নিতে; তখন নাকি দাম কমবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, যারা নিয়ম মোতাবেক ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করে সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হবে না; সেই আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আমরা নীতিগত সহায়তা দিয়ে যাব। কিন্তু কেউ মজুতদারি করে মূল্য শৃঙ্খলে ব্যত্যয় ঘটালে তাকে বা তাদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে; এটি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, পণ্যের দাম ক্রেতার সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আর কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি বা অবৈধ মজুত গড়ে পণ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব নয়। এ সময় পরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অন্য ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহণে চাঁদাবাজির বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলার আশ্বাস দেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম কমেছে। আসন্ন রমজান ঘিরে ৮ পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন ও ৪ পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব নেই; উল্টো দাম বাড়ছে। অন্যবারের মতো এবারও বাজারে সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে রমজাননির্ভর পণ্যের ওপর। এতে ভোক্তার জন্য সরকারের ছাড়ের সুবিধা চলে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের পকেটে। ফলে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ