লুটে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা
মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চালের মোকাম
প্রকাশিত: জানুয়ারী ১৭, ২০২৪, ০৬:৩৮ বিকাল

দেশে চালের উৎপাদন, বিপণন, গুদামে মজুত ও আমদানি সবকিছুতেই এবার রেকর্ড হয়েছে। চাহিদার তুলনায় খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকছে। উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমে, অর্থনীতির এ নিয়ম চালের ক্ষেত্রে উল্টো।
জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে মোকামের চালকলের মালিকরা ধানের মূল্যবৃদ্ধির খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। নতুন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্ব রদবদলের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ক্রেতাদের পকেট কাটতে শুরু করেছে চক্রটি।
মিল মালিকদের অভিযোগ, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন অটো মিল মালিকরা। তারা দাম বাড়িয়ে দিলে বাজারে দাম বেড়ে যায়। ধানের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে গত দুই সপ্তাহে প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ২-৪ টাকা। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালের বেশির ভাগই চলে গেছে সিন্ডিকেটের কব্জায়। এর সঙ্গে রয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ী, মিলার, আড়তদার, পাইকার, অনলাইন ব্যবসায়ীসহ কিছু প্রতিষ্ঠান। তারা সবাই ধান কিনে চাল মজুত করেছেন। নিজেদের গ্রাহকদের চাহিদামতো বাড়তি দামে সরবরাহ করছেন। এতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় একটি পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে। ফলে তারা পরিকল্পনামাফিক চালের দাম বৃদ্ধি করতে পারছেন।
সারাদেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কুষ্টিয়া জেলার ৪৬ অটো চালকল মালিক। তারা প্রতি বছর এ সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়ে লুটে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এখান থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে একশ ট্রাকের বেশি চাল পাঠানো হয়। প্রতি ট্রাকে প্রায় ২০-২৫ টন চাল যায়। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে এই চাল থেকে কোটি কোটি টাকার বাড়তি মুনাফা তুলে নিচ্ছে এখানকার মিল মালিকদের সিন্ডিকেট। সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা আর নানা সুযোগে চালের বাজার অস্থির করে তুলছেন তারা। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে চালের মোকামে সব ধরনের চালে কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। আড়তে চাল সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনেক মিল মালিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ধানের দাম বৃদ্ধি ও মোকামে চাল সংকটের অজুহাতে নতুন করে সব ধরনের চালে কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। অথচ ধানের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে বাড়েনি বলে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। চালের দাম মোকামে অর্থাৎ মিল গেটে এক টাকা বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যোগ করে ভোক্তাকে আরও তিন টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ ধরে খুচরা বাজারে সব ধরনের চাল কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এখানে খুচরা বাজারে মাঝারি মানের আটাশ চাল বিক্রি হয় ৪৮-৪৯ টাকা কেজি দরে। ৬২ টাকার মিনিকেট (সরু) চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়। ৫৬ টাকায় বিক্রি হওয়া কাজললতা চাল এখন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কয়েকজন চাল বিক্রেতা জানান, বেশি দামে মোকাম থেকে চাল কিনতে হচ্ছে। তাই খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। কয়েকদিন আগে কাজললতা চাল ৫৬ টাকায় বিক্রি করেছেন। সেটি এখন ৬০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, খাজানগর মোকামে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চালকলের মালিকরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে সব ধরনের ধানের দাম বাড়তি। এ কারণে বাধ্য হয়ে তাদের চালের দাম বৃদ্ধি করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান জানান, ডিসেম্বর মাস থেকে ধানের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সব ধরনের ধানের দাম মণপ্রতি ১৮০-২০০ টাকা বেড়েছে। নভেম্বর মাসে সরু ধানের দাম ছিল ১ হাজার ৪২০ টাকা মণ। বর্তমানে ওই ধান কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৬৮০ টাকায়। মাঝারি মানের ধানের দাম বেড়ে এখন হয়েছে ১ হাজার ৩৭০ টাকা মণ। এ কারণে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে আড়াই টাকা বেড়েছে মোকামে। তবে খুচরা বিক্রেতাদের দাবি চালের দাম কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বাড়িয়েছেন চালকলের মালিকরা।
এক অটো মিল মালিক বলেন, সারাদেশে অটো মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা যোগাযোগ করে দাম বাড়িয়ে দেন। এবার এ সময়ে ধানের দাম অল্প বেড়েছে। তবে যে দাম বেড়েছে, এতে চালের বাজার প্রতি কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বৃদ্ধির কথা নয়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। বেসরকারি হিসাবে বেড়েছে ১৪ শতাংশ। গত বছরের এ সময়ে মিনিকেট চাল ছিল ৫৮ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা কেজি। প্রতি বছর ভর মৌসুমে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত কমে। এবার কমেনি, বরং বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে ৪ কোটি ৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ টন। এর বিপরীতে উৎপন্ন হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টনের বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি পাওয়া গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ২৯ লাখ টন। এছাড়া গত অর্থবছরের উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩০ লাখ টন। এসব মিলে চলতি অর্থবছরে খাদ্যের সরবরাহের লাইনে আছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে চালের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টন। এ হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে ১ কোটি ১৮ লাখ টন। আগে কখনোই এত বেশি চাল উদ্বৃত্ত হয়নি। এত চাল উদ্বৃত্ত থাকার পরও কেন চালের দাম বাড়ছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য ধরে হিসাব করলে উদ্বৃত্ত এত নাও থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। তবে দাম কেন বাড়ল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি যদি ধান মজুতের কারণে হয়, তাহলে সেটি বন্ধ করতে অধিদপ্তরের একাধিক টিম কাজ করছে। কোনো অসঙ্গতি থাকলে অসাধুদের বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ