অপরিকল্পিত উন্নয়নে লোকসান
পর্যটনে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে ঘটবে বিপ্লব
প্রকাশিত: জুন ০৮, ২০২৪, ০৭:১২ বিকাল

দেশের পর্যটনে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেখানে ভালো ব্যবসা করছে, সেখানে সরকারের হোটেল-মোটেল ও পর্যটনকেন্দ্র লোকসান গুনছে। পর্যটন খাতের উন্নয়নে চার বছর আগে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে পর্যটনশিল্প বিকাশে কাজ শুরু করা যায়নি। বেশকিছু পর্যটন এলাকার উন্নয়নে কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হলেও বছরের পর বছর ধরে তা চলছে। সরকার বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে না পারায় প্রতি বছরই বরাদ্দের বড় অংশ ফেরত যাচ্ছে। অপার সম্ভাবনার এ খাতটি রীতিমতো ধুঁকছে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটার মতো পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। বিদেশি পর্যটকও বাড়ছে না আশানুরূপ।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৮ সালে ৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পেলেও ছয় বছরে ১০ শতাংশও কাজ হয়নি। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পটির আওতায় ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও খরচ করতে না পারায় ১০ লাখ টাকা রেখে বাকিটা ফেরত নেয়া হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে এই বেহাল দশার বিষয়ে পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. মাহমুদ কবীর বলেন, চলতি অর্থবছরে দুটি প্রকল্প শেষ হবে। সে অনুযায়ী তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পঞ্চগড়ে পর্যটনকেন্দ্রের স্থান পরিবর্তন করতে সময় লেগে গেছে। সেটির ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। নিঝুম দ্বীপ ও হাতিয়ায় ডিজাইন পরিবর্তন করতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল। সেটি আবার ব্যয় কমিয়ে প্রকল্প সংশোধন করে অনুমোদন নিতে হবে। কোচ কেনার প্রকল্পটি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আটকে আছে। ডলার রেট বেশি হওয়ায় অনেকে আগ্রহী হচ্ছে না। পর্যটন লোকসানে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো অনেক পুরনো। সেখানে ভালো আয় হচ্ছে না। আবার নিজেদের অর্থ না থাকায় সংস্কারও করতে পারছি না। সেগুলো বেসরকারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার পরিকল্পনায় কাজ চলছে।
বেশির ভাগ প্রকল্প চলছে ৬ বছরের বেশি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও দুই প্রকল্পের খরচ খাতাই খোলেনি
পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় ট্যুর পরিচালনার লক্ষ্যে ২০২১ সালে ২২৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ট্যুরিস্ট কোচ সংগ্রহ প্রকল্প নেয়া হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েও নির্দিষ্ট সময়ে কোচ কিনতে পারেনি পর্যটন করপোরেশন। চলতি অর্থবছরে কোচ কেনার জন্য ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও কেনা যায়নি কোচ। ফেরত নেয়া হয়েছে টাকা। গত কয়েক বছর ধরেই তেমন লাভ দেখছে না পর্যটন করপোরেশন। সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসান হয় ৪ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান দেখিয়েছে সংস্থাটি।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় ৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা আলোর মুখ দেখছে না। ফলে পর্যটন এলাকাগুলোয় অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে। দ্রুত সরকারকে পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। তবে মহাপরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। এখন এ মহাপরিকল্পনায় কোনো ভুল-ত্রুটি আছে কিনা, তা দেখা হচ্ছে। ঠিক কবে চূড়ান্ত করা হবে, তা কেউ বলতে পারেননি।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন চূড়ান্ত করার কথা ছিল। ওই সময়ে মহাপরিকল্পনার প্রায় সব কাজই গোছানো হয়। বই আকারে তা ছাপানো হয়েছে। শিগগির তা চূড়ান্ত করা হবে। তখন ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের পর্যটন নতুন যুগে প্রবেশ করবে। দেশের পর্যটন খাতে ঘটবে বিপ্লব।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ বলেন, আমাদের দেশে পর্যটনের বহু জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে পর্যটন কখনই অগ্রাধিকার পায় না। এ জন্য পর্যটনবান্ধব মহাপরিকল্পনার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা নেপাল পর্যটনকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেয়। আমাদের এখানে পর্যটন কখনই অগ্রাধিকার পায় না। বিদেশি পর্যটক আসার ক্ষেত্রে ভিসা জটিলতা একটি বড় সমস্যা। বিদেশি পর্যটক আসার ব্যাপারে আমরা এখনো উদার হতে পারছি না। বেশির ভাগ দেশ এখন ই-ভিসা, অন অ্যারাইভাল ভিসা দিচ্ছে কিন্তু আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিসা দিতে চাই না। বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে দেশের মানুষের আচরণের পরিবর্তন অপরিহার্য। এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তা পর্যটন মহাপরিকল্পনায় থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জুনে বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে মহাপরিকল্পনা তৈরির চুক্তি করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এ চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু হয়। ওই বছরের ৩০ জুন তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারিগরি জটিলতায় কাজটি আটকে যায়। পরে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যেও এ মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। অথচ এখন পর্যন্ত ভ্যাট ও এআইটিসহ এ প্রকল্পে প্রায় ২৮ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
দৈনিক সরোবর/কেএমএএ