ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতে জোর চেষ্টা সরকারের

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২৪, ০৮:২৪ রাত  

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ট্রাইব্যুনালকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে প্রসিকিউশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১০ কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। 

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব হত্যাকান্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। এ ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় হাসিনাসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে একের পর এক গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ জমা পড়ছে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারপতি ফ্যাসিবাদী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এসব বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে সুপ্রিম কোর্টের নিজেদেরই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। 
শেখ হাসিনা কোথায় আছেন জানেন কি না প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, শেখ হাসিনা কোথায় আছেন, এখন সেটা নিয়ে ভাবছি না। তারা যে অপরাধ করেছেন, তার বিচার নিয়ে কাজ করছি। বিচারের কোনও পর্যায়ে গিয়ে যদি শেখ হাসিনার উপস্থিতির প্রয়োজন হয়; তখন তার খোঁজ নেবো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি সপ্তাহের যে কোন কার্য দিবসে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও অপর দুই সদস্য নিয়োগ দেওয়া হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তত ৬০টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় চালানো হত্যার ঘটনায়। আর একটি অভিযোগ ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা নিয়ে। 

মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে অন্তত ৬০টি অভিযোগ 

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুসারে গত ১৫ জুন অবসরে যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হাইকোর্টের বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার। এর পর সরকার পতনের পর অপর দুই সদস্যের মধ্যে একজন বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমকে মধ্য আগস্টে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অপর সদস্য (ঢাকার সাবেক জেলা ও দায়রা জজ) হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া জিন্না ২৭ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এর পর আর কাউকেই তাদের স্থানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিন মাস কোনো বিচার কার্যক্রম নেই। সূত্র জানায়, রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ বিচারালয়ের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদ শূন্য রয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন না হওয়ায় বিচারকাজ শুরু করা যায়নি। গত সাত মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রায় হয়নি। ফলে বিনাবিচারে থাকা দেড় শতাধিক আসামি দীর্ঘদিন জেল খাটছেন। বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি।

তথ্য মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আওয়ামী লীগের আমলে গুমের ঘটনায়, ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের হয়েছে প্রায় ৬০টি। কিন্তু বিচারক নিয়োগ না হওয়ায়; থমকে আছে বিচার প্রক্রিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ। তবে আর সময় নষ্ট করতে চায় না সরকার। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, যে কোনো সময় বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হবে। হাইকোর্টে নতুন নিয়োগ হওয়া বিচারকদের মধ্যেই কয়েকজন যেতে পারেন ট্রাইব্যুনালে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় দায়ের করা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট তদন্ত সংস্থায় প্রথম অভিযোগ দাখিল করা হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হাইকোর্টের নতুন ২৩ বিচারপতির মধ্যে অন্তত দুজন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুক্ত হতে পারেন। এ নিয়ে যে কোনো সময় প্রজ্ঞাপন হবে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গণহত্যাসহ সারাদেশে সংগঠিক মানবতাবিরোধী অপরাধের বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছে। এ প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনালের মূল ভবনে এজলাস সরাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। 

ট্রাইব্যুনাল গঠন নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরু হবে। কারণ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন ছাড়া আদালতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনেক আদেশ আমরা নিতে পাচ্ছি না। 

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে সবকটির তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল, সিএমএইচ ও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়ে সেখানে আহতদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টকে কেন্দ্র করে সারাদেশে যেসব হত্যা মামলা হয়েছে; সেগুলো একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ৩০টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন। এ ট্রাইব্যুনালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় নৃশংসতায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে চিহ্নিত অনেকের ফাঁসিসহ সাজা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মামলাগুলোর কয়েকজন আসামির স্বজনেরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন করেছেন। তারা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে আসামিদের মুক্তির দাবি জানান।  

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। বর্তমানে ৬ জন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) কাজ করছেন। শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে; সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিসি-এসপি, সিভিল সার্জন, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হতাহতের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য হাতে এলে তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করা যাবে। 

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলে আগে থেকে বিচারাধীন মামলাগুলোর আগে নিষ্পত্তি হবে। এরপরই সাম্প্রতিক সময়ে গণহত্যার অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হবে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ