সর্বজনীন পেনশন: উল্টো পথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা
প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৪, ০৭:৫২ বিকাল

গত বছরের ১৭ আগস্ট দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হয়। শুরুর দিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত সব পেশাজীবী সংগঠন এটিকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। সে সময় এ নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী ঘরানার শিক্ষক নেতারাও। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা, এমনকি উপাচার্যরাও এটিকে যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেন। উচ্ছ্বাস জানিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন কলামও। তবে মাত্র সাত মাস না পেরোতেই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। এখন তারা এটির বিরোধিতা করছেন। কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এমন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছেন না। শিক্ষকদের পেনশন স্কিমের আওতার বাইরে রাখার দাবিতে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা দিচ্ছেন বিবৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, সরকারের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সরকারের এ উদ্যোগটি সর্বসাধারণের জন্য ভালো। তাদের আপত্তি হলো, ‘প্রত্যয়’ নামে নতুন যে স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি নিয়েই তাদের অনুযোগ। নতুন এ স্কিমে অবসরের পর এককালীন অর্থ পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বৈষম্যের শিকার হতে হবে। এজন্য তারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে চান না। পেনশন পেতে চান আগের নিয়মে। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘প্রত্যয়’ স্কিমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরের পর মাসিক ভাতা পাবেন। আগে প্রভিডেন্ট ফান্ডে সংস্থার দেওয়া অর্থ কর্মচারীর ‘কন্ট্রিবিউশন’, এরচেয়ে কম হলেও প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠানকে কর্মীর সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে। এমন শর্ত থাকায় পেনশনার অধিক লাভবান হবেন।
‘প্রত্যয়’ স্কিমের বিরোধিতা কেন: গত বছরের আগস্টে চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশনে নতুন প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ মার্চ এ নিয়ে দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনে প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন এ স্কিমের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে।
প্রজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তির তথ্যানুযায়ী, আগামী ১ জুলাই বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই এটি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। শিক্ষকদের আশঙ্কা, প্রত্যয় স্কিম কার্যকর হলে আগামীতে যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করবেন, তাদের আর্থিক সুবিধা কমে যাবে।
শিক্ষক নেতারা জানান, বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। কর্মকর্তা রয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি। কর্মচারীসহ সবমিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অথচ সরকারের অন্য চাকরিজীবীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের ক্ষেত্রে আগের নিয়মেই পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রত্যয় স্কিমের যে রূপরেখা, তা অমরা দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যোগদান করা শিক্ষকরা এককালীন আর্থিক সুবিধা পাবেন কি না, সেটি স্পষ্ট নয়। পেনশন, এককালীন সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত বলাও হয়নি।
তিনি বলেন, এটি সর্বজনীন পেনশন। তাহলে এটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়বে। অবসরকালীন নিশ্চয়তা একই রকম না থাকলে আগামীতে মেধাবীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, প্রত্যয় স্কিম চরম বৈষম্যমূলক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। নিজস্ব বেতন কাঠামো, নিজস্ব পেনশন সিস্টেম, সব ক্ষেত্রেই স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন। সুতরাং নতুন এ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করতে চাই না।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষকদের বেতন কম, তেমন সুযোগ-সুবিধাও নেই। সর্বশেষ যে পেনশন, সেটাও যদি অভিন্ন নীতিমালায় চলে যায়, সবার জন্য একই হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মেধাবীরা কেন আসবে? স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষকবান্ধব নীতি। আশা করি সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আগের নিয়মে পেনশন চালু রাখবে।
আন্দোলনে নামছেন শিক্ষকরা, প্রস্তুত রূপরেখা: সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এরই মধ্যে এ আন্দোলনের একটি রূপরেখাও তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। রূপরেখা অনুযায়ী, সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি পেনশন ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা জানান, আন্দোলনের রূপরেখা অনুযায়ী প্রথমে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ক্রমে বিবৃতি দেবে। রমজান ও ঈদের ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে মাঠের কর্মসূচিতে নামবেন শিক্ষকরা। দ্বিতীয় ধাপে তারা র্যালি, মানববন্ধন করবেন। এতেও যদি সরকারের টনক না নড়ে, তাহলে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কর্মবিরতির মতো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তারা। ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সর্বজনীন পেনশনের প্রজ্ঞাপন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। রমজানের কারণে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। ঈদের পর ধারাবাহিক কর্মসূচিতে যাবো আমরা।
কর্মসূচির রূপরেখার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা একটি উপ-কমিটি করেছি। এ কমিটিতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন। তাদের নিয়ে শিগগির সভা হবে। সেখানে কর্মসূচি চূড়ান্ত করবো। আমরা আশা করছি, তার আগেই সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে বিষয়টি সমাধান করবে। আমরা চাই না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হোক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান বলেন, এটা (সর্বজনীন পেনশন) নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। আমরা শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো। পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে বসেও কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পেনশন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাবিদরা যা বলছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানজেমেন্ট ইনফরমেনশন সিস্টেম বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান চৌধুরী। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বরত। গত বছরের আগস্টে সর্বজনীন পেনশন চালু হওয়ার পরপরই একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে কলাম লিখেছিলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। সেখানে তিনি এটিকে ‘যুগান্তকারী পদক্ষেপ’ উল্লেখ করেছিলেন। সেখানে তিনি সর্বজনীন পেনশনের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করে লিখেছিলেন, আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা কখনো প্রবর্তন হতে পারে তা আমি কখনো ভাবিনি। তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার পরও এ স্কিমটি ঐতিহাসিক বা যুগান্তকারী ব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এখন এটির বিরোধিতা করছেন, বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন এটির বিরোধিতা করছেন, সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট জানি না। তাদের মনোভাব বোঝার সুযোগ এখনো হয়নি আমার। শিক্ষকরা এককালীন পেনশন পেতেন, আবার নির্দিষ্ট পিরিয়ডের জন্যও গ্রহণ করা যেতো। এখন হয়তো নতুন পলিসিতে শিক্ষকদের নিজেদের কন্ট্রিবিউশন করতে হচ্ছে, এজন্যই বিরোধিতা করছেন। আমার ধারণা, সেটাই মূল কারণ।
তিনি আরো বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে দায়িত্ববোধও সম্পর্কিত। আমি মনে করি, স্বায়ত্তশাসন মানেই স্বাধীনতা নয়। একজন শিক্ষকের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ অর্থায়ন হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। সেখানে সরকারের নীতি তো মানতে হবেই। স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞাটা চিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়ে গেলে বড় সমস্যা তৈরি হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষের কথা জেনেছি। যদি এ নিয়ে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন আমাকে কোথাও (সরকারের উচ্চপর্যায়ে) কথা বলতে বলেন, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, প্রজ্ঞাপনের পর থেকে শিক্ষকরা এটি নিয়ে অসন্তোষ জানাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা (শিক্ষক সমিতি) কাজ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ নিয়ে কোনো মতামত নেই। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, প্রত্যয় স্কিমের যে রূপরেখা, তা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। নতুন ধারণা হওয়ায় অনেকে এখনো হয়তো বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রত্যয় স্কিমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে যে টাকা মাসিক ভিত্তিতে জমা হবে, তার মূল টাকা ও মুনাফার ওপর অবসরে গেলে মাসে মাসে পেনশন দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিক্ষকরা যদি আরো বিস্তারিত জানতে চান, আমরা জানাতে প্রস্তুত।
দৈনিক সরোবর/এএস