ঢাকা, সোমবার, ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১ ভাদ্র ১৪৩১

অবরোধে অচল ঢাকা

আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ও অ্যামনেস্টির নিন্দা

সরোবর  ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৪, ০৮:১০ রাত  

কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গতকাল ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা, কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং কোটা প্রথার যৌক্তিক সমাধানের দাবিতে মঙ্গলবার নতুন করে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা।এর ফলে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও সড়কে অবস্থান নেয়ায় কয়েকটি স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, ছাত্রলীগও আজ দুপুর থেকে তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে এবং বেলা দেড়টা থেকেই দেশ জুড়ে এ বিক্ষোভ শুরু হয়।
এদিকে সোমবারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর।

গতকালের হামলায় ঢাকায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সোমবারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর।

এর আগে, রবিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর করা এক মন্তব্যের পর ওই রাতেই নতুন করে ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু হয় ঢাকাসহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরপর সোমবার ঢাকাসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার ঘটনা ঘটে। তবে, ছাত্রলীগ এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো তাদের কর্মীদের ওপর আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যামনেষ্টির নিন্দা: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের চলমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ঘটনা তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানান তিনি।

তিনি বলছিলেন, আমরা ঢাকা ও বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থী বিক্ষোভের বিষয়ে সচেতন ও পর্যবেক্ষণ করছি, যেখানে দুজন নিহত হয়েছে এবং শত শত আহত হয়েছে। 

তবে মিলার দুইজন নিহত হবার যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিবিসি নিশ্চিত করতে পারেনি। এদিকে, মিলারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মিলার বলেছেন, মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা যে কোনো ক্রমবিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতার নিন্দা জানাই। যারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি সমবেদনাও জানান মিলার।

এদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন মঙ্গলবার দুপুরে এক বিবৃতিতে বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুইজনের মৃত্যুর যে দাবি করেছেন, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। যাচাই না করে ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এমন মন্তব্য সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশে কোটা বিরোধী বিক্ষোভে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটি 'বিক্ষোভকারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য' সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধ: সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর দুইটার দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিলসহ ঢুকতে শুরু করেছে। নানা ধরণের পোস্টার, প্লাকার্ড হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে।

এদিকে, ঢাকার নতুন বাজার এলাকা ছাড়াও প্রগতি সরনী, বনানী ছাড়াও উত্তরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নিয়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে প্রগতি সরনী অবরোধ করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

রামপুরা ব্রিজ এলাকায় থাকা বিবিসির সংবাদদাতা মুকিমুল আহসান জানিয়েছেন, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নেয়ায় রাস্তার দু’পাশেই যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

এছাড়ারা, বনানীর কাকলি এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়েছে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ কারণে শহরের ব্যস্ততম এলাকাটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে নগরীর আরেক ব্যস্ত এলাকা মিরপুর-১০ গোলচত্বরে। সেখানেও আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিসির সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ জানান, পুরো ক্যাম্পাসই এখন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিং হয়েছে।

এছাড়ারা, ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহে টাউন হল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নিয়েছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ফলে শহরের ভেতরে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে কয়েকটি এলাকা প্রদক্ষিণ করে এসে আবার কলেজের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়েছে। রাজশাহীতে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থানের খবর পাওয়া গেছে। ঝিনাইদহে একটি স্কুলের মাঠে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হয়েছে এবং এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছে।
 
প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন?: রবিবার চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসেলে সরকারের কিছু করার নেই।

তিনি সেখানে প্রশ্ন করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের জের ধরে ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কার এর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল সমাবেশে মধ্যরাতে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সে সময় কয়েকটি ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। মধ্যরাতে মিছিলকারীরা আবাসিক হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং ‘কোটা নয় মেধা-মেধা মেধা’- এ ধরনের স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকে। অবশ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ‘তুমি কে আমি কে - রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় সামাজিক মাধ্যমে। যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, 'প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাজাকার বলায় তারা এমন স্লোগান দিয়েছেন।' কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন শিক্ষার্থীরা বিবিসিকে বলেছেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে তারা ওই স্লোগান দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর করা মন্তব্যকে 'অপমানসূচক' বলে বর্ণনা করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

রবিবার রাতেই প্রধানমন্ত্রীর করা মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের সাথে জড়িত কয়েকজন ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে জানা যায়। ২০১৮ সালে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবরকম কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে সরকার। সম্প্রতি সেই পরিপত্র বাতিল করে উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চলতি মাসের শুরু থেকে টানা আন্দোলন ও 'বাংলা ব্লকেড' নাম দিয়ে অবরোধের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচির কারণে গত সপ্তাহে কয়েকদিন শহরে তীব্র যানজট তৈরি হয় এবং মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

এর মধ্যে রবিবার দিনের বেলায় আন্দোলনকারীরা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দেয়। এতে সংসদের অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেয় আন্দোলনকারীরা।পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা এ সময়ের মধ্যে তুলে নেওয়ার দাবি জানায়। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস