ঢাকা, সোমবার, ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১ ভাদ্র ১৪৩১

দেশে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশই কর্মক্ষম 

সরোবর  ডেস্ক

 প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৪, ০৯:০৫ রাত  

দেশের জনসংখ্যা এখন সরকারি হিসেবেই ১৭ কোটি ১৫ লাখেরও বেশি। আয়তনে ছোট একটি দেশে এই জনসংখ্যা বিশাল এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশের জন্য সুবিধা হচ্ছে, এই জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশই কর্মক্ষম অর্থাৎ বয়সের দিক দিয়ে তারা কাজের উপযোগী আছেন। যদিও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩৫ সালের পরে বাংলাদেশের এই কর্মক্ষম জনশক্তির হার কমতে থাকবে। বিপরীতে বাড়বে শিশু, বৃদ্ধদের মতো নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা। অতীতে চীন-জাপানের মতো দেশগুলো তাদের বাড়তি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলেও বাংলাদেশ সেটা কতটা কাজে লাগাতে পারছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন তার বিপুল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না? এক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনাই বা কী?

কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কত?: বাংলাদেশে সর্বশেষ জনশুমারি হয় ২০২২ সালে। এটির উপর ভিত্তি করে চলতি বছর জনসংখ্যার একটি প্রাক্কলিত হিসাব দেয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস।সেই হিসাবে দেখা যায়, দেশটিতে এখন মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। এরমধ্যে দেশটিতে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটিরও বেশি। এই মানুষগুলোকেই মূলত: বলা হয় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বয়সের দিক দিয়ে তারা কাজে নিযুক্ত হওয়ার উপযুক্ত।এই সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ৬৫ বছরের উর্দ্ধে তাদের বলা হয় নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী অর্থাৎ তারা জীবিকার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করেন।এমন মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ।

সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি বলা হচ্ছে, 'ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট' বা 'জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকাল'। শ্রমশক্তি কাজে লাগছে?: বাংলাদেশ জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকালের যুগে প্রবেশ করেছে ২০০৫ সালের পরে। তখন থেকে এটি ক্রমাগত উর্দ্ধমুখী, যা এখনো বজায় আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, শ্রমশক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও এটা বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ে যে প্রক্ষেপণ সেটায় দেখা যাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা সেটা সর্বোচ্চ ২০৩৫ বা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত এটা উর্দ্ধমুখী থাকবে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়তে থাকেব। কিন্তু এরপর এটা কমতে থাকবে। ২০৪৭ সালের দিকে গিয়ে দেখা যাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর চেয়ে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে যেটা হবে জনসংখ্যা কাঠামোয় এখন যে পরিবর্তন যেটা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত আমাদের অনকূলে থাকবে। কোনও দেশে শ্রমশক্তি বাড়লে সেটা ঐ দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিতে পারে। এজন্য দরকার হয় শ্রমশক্তি অর্থনীতিতে কাজে লাগানো। অর্থনীতিতে ব্যবহার করতে পারলেই সেটা 'লভ্যাংশ' হিসেবে বিবেচিত হবে।

‘অথনীতির যে বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি সেটা আরও বাড়ানোটাই হচ্ছে জনমিতিক লভ্যাংশ। এটা তখনই বাড়বে যখন কর্মক্ষম লোকগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। এজন্য তাদেরকে শ্রম বাজারে আনতে হবে, চাকরি দিতে হবে, মানসম্মত জীবন-যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’- বলেন অধ্যাপক ইসলাম।

চ্যালেঞ্জ কোথায়: বাংলাদেশ যে বাড়তি শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করতে পারছে না তার মূল কারণ দেশে যথেষ্ট কর্মসংস্থান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসেবে দেশটিতে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরো বেশি বলেই মত অর্থনীতিবিদদের। এছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর তথ্যানুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্বই প্রায় ৮০ শতাংশ।ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান দরকার। কিন্তু কাজের সুযোগ যথেষ্ট তৈরি হচ্ছে না। মোটাদাগে এর তিনটি কারণ তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রথমত: কর্মমুখী শিক্ষায় ঘাটতি। গতানুগতিক শিক্ষা শেষে কাজ পাচ্ছে না তরুণরা। কারণ বাজারে যেসব কাজের চাহিদা, দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে তরুণদের মধ্যে সে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত: বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সেভাবে উন্মুক্ত হচ্ছে না। ফলে বেকারদের একটা বড় অংশের গন্তব্য অভিবাসন। কিন্তু সেটার সুযোগ সবার নে। আবার যারা শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের দক্ষতায়ও ঘাটতি থাকছে। ফলে তারা নিম্নমজুরির কাজ করছেন। এর ফলে রেমিটেন্সও কম আসছে।

তৃতীয়ত: দেশে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ উন্নত নয়। ফলে এখানে কোন চাকরিতে না গিয়ে যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তারা যথেষ্ট পুঁজি পাচ্ছেন না এবং ব্যবসার পরিবেশেও ঘাটতি আছে। জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারকে কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করতে হবে।

তার মতে, এখানে তরুণদের যে দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না, কাজ পাচ্ছে না এটার দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। তিনি বলেন, দেখুন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিন্তু হচ্ছে। কিন্তু সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। কারণ এখানে বিনিয়োগ নেই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। যার কারণে এই অবস্থা। তরুণদের যে শিক্ষাগত যোগ্যতা সেটা চাকরিতে কাজে লাগছে না। সবাই গতানুগতিক অনার্স, মাস্টার্সের পড়াশোনা করছে। অথবা বিবিএ-এমবিএ করছে। বাজারে তো এতো চাহিদা নেই। এজন্য দক্ষতা-ভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।  স্বাস্থ্য-শিক্ষায় দরকার মেগা প্রকল্প: অর্থনীতিবিদ ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বাড়তি শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বিনিয়োগ সরকার কোন খাতে করবে? এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রধানত দুটি খাতের কথা তুলে ধরছেন। একটি হচ্ছে, কর্মমুখী শিক্ষা। অপরটি হচ্ছে স্বাস্থ্য। কিন্তু দুটোতেই বাংলাদেশের বাজেটে সরকারি বরাদ্দ নামমাত্র। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা জিডিপির দুই শতাংশের কম, আর স্বাস্থ্যে সেটা এক শতাংশেরও নিচে। অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেল (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের এখন দরকার মানবসম্পদ উন্নয়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট। আমাদের এখানে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যেমন মেগা প্রজেক্ট আছে। তেমনই সামাজিক উন্নয়নেও মেগা প্রকল্প দরকার। সেটা হবে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতে।

তিনি মনে করেন, আগামী কয়েক বছরে এই দুটো খাতে খুব বড় ধরণের বিনিয়োগ না হলে বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে হারিয়ে ফেলবে বাংলাদেশ। এই সময়টা পার হয়ে গেলে তখন অর্থ খরচ করেও প্রবৃদ্ধির কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো না।

গবেষকরা বলছেন, একদিকে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ কম, অন্যদিকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনারও অভাব আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সরকারের যে পরিকল্পনা সেটায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের এখানে ২০৪১ সালের পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান তৈরি করার কথা বলা আছে এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করার কথাও আছে। কিন্তু বলা আছে, ২০৪১ সালে গিয়ে শিক্ষায় জিডিপির চার শতাংশ আর স্বাস্থ্যে দুই শতাংশ বিনিয়োগ করবে। কিন্তু সেই বিনিয়োগটা ২০৪১ সালে নয় বরং এখনই করতে হবে। না হলে এর রিটার্ন পাওয়া যাবে না। সরকারকে এটা বুঝতে হবে।

ইসলাম বলছেন, ২০৪৭ সালের পরে বাংলাদেশের অবস্থা হবে অনেকটা জাপানের মতো। যেখানে বয়োবৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তখনকার সময়ের জন্য বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। কিন্তু সরকার তাহলে কেন মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে না? বিশেষ করে গেলো দেড় দশকে বড় বড় অবকাঠামো নির্মানে ব্যাপক বিনিয়োগ হলেও শিক্ষা-স্বাস্থ্যে কেন মানসম্মতভাবে ব্যয় বাড়ানো যায়নি সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

তবে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান অবশ্য বলছেন, সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রাধিকার থাকে। একটি রাজনৈতিক সরকারকে সেসব বিষয়ে আগে কাজ করতে হয়। অভাবের সংসারে নানা রকমের হার্ড চয়েস করতে হয় সরকারকে। আমাদের তো আগে বাঁচতে হবে। তা ছাড়া শুধু অর্থ বরাদ্দ করলেই হবে না, সেটা খরচের সক্ষমতা থাকতে হবে। আবার শুধু খরচ করলেই হবে না, সেটা নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। আমরা ধীর ধীরে শিখছি। সামাজিক খাতে বরাদ্দ এবং কাজ বাড়ছে। আরও তিন/চার বছরের মধ্যে পরিস্থিতি আরও অনুকূলে আসবে। সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন যেভাবে তরুণ জনগোষ্ঠী বাড়ছে, সেটা বেশিদিন থাকবে না। অন্যদিকে তরুণদের কাজ কিংবা ব্যবসার সুযোগ না দিতে পারলে সেটা বেকারত্ব আরও বাড়িয়ে অর্থনীতিতে বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি করবে। কিন্তু ভবিষ্যতের সেই ঝুঁকির পরিবর্তে অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা মোকাবেলাই এখন সরকারের বড় অগ্রাধিকার। ফলে ব্যয় হচ্ছে সেভাবেই এবং বাজেটসহ অর্থনীতির বড় পরিকল্পনাগুলো তৈরি হচ্ছে সেটাকে ঘিরে। তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস