ঢাকা, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১

নিঃস্ব হচ্ছেন দরিদ্ররা 

হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা প্রকট

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: জানুয়ারী ৩০, ২০২৫, ০৩:৪৮ দুপুর  

উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। একই চিকিৎসা বাংলাদেশে করতে যে ব্যয় হয়ে থাকে, তা করতে ভারতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩ থেকে ১০ গুণ বেশি। তবে হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতি হিসাব করলে খরচ প্রায় কাছাকাছি হয়ে আসে। এ কারণে দেশীয় চিকিৎসার প্রতি অনীহা বেড়েই চলেছে দিন দিন। কিছুতেই কাটছে না দেশীয় চিকিৎসায় আস্থার সংকট। চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট ও রোগ নির্ণয় বা চেকআপের অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে সেবা নিতে যাচ্ছেন রোগীরা। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট ও প্রতারণার ফাঁদ। চিকিৎসা নিতে ধনীরা বিদেশ যাচ্ছেন। সেবা নিয়ে দরিদ্র শ্রেণি নিঃস্ব হচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্য খাত আস্থার সংকটে পড়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল টুরিজম কেবল অন্য একটি দেশে সেবা নেওয়া নয়। এর কারণে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সক্ষমতা ও দুর্বলতার চিত্র ফুটে ওঠে। দেশের স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। চিকিৎসার বিদেশমুখিতার জন্য বাংলাদেশ প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারায়। অর্থপ্রবাহ কেবল একটি আর্থিক বিষয় নয় এটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সমস্যা। এ লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

জানা গেছে, উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছে বিদেশে। এতে দেশে অর্থনৈতিক খাতে প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ বিদেশ যান মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য। যত রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান তার ৫ শতাংশ চিকিৎসক। চিকিৎসার জন্য বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ বিদেশে বেশি যায় সেই তালিকার দশম স্থানে বাংলাদেশ। 

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থার সংকট আছে। এখানে চিকিৎসা খরচ বেশি, চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় রোগীদের। চিকিৎসা সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। এসব কারণ রোগীদের বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করছে। তিনি বলেন, রোগীদের বিদেশ যাওয়া ঠেকাতে সরকারি হাসপাতালে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টানিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করে দিতে হবে। রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবেন। ডায়াগনস্টিকেও দাম নির্ধারণ করে মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রেসক্রিপশন অডিট চালু করতে হবে।

সংকটে ভুগছে দেশের স্বাস্থ্য খাত; প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দিন দিন বেড়েই চলছে অনীহা

দেশে আন্তর্জাতিক মানের ভালো চিকিৎসক থাকলেও নানাবিধ কারণে রোগীরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। আর এই আস্থা হারানোর পেছনের কারণ হিসেবে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। মূলত একশ্রেণির ডাক্তার অনৈতিক মুনাফাবাজি, বাণিজ্যিক ও অপেশাদার মনোভাবের কারণে দেশের পুরো স্বাস্থ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও কিছু নৈতিকতাহীন চিকিৎসকের নেতিবাচক ভূমিকায় সাধারণদের আস্থার সংকট প্রকট হচ্ছে। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হতেও নাকি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। 

দেখা যাচ্ছে, দেশীয় হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবার প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। অথচ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চিকিৎসা খাতে সাধারণ মানুষের আস্থার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটেছে এর উল্টো। ভুল চিকিৎসা,  ভুয়া চিকিৎসক, রোগীর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া, রোগীর কাছ থেকে অনৈতিক অর্থ আদায়, বেসরকারি হাসপাতালে খরচের বাড়াবাড়ি, নকল ওষুধ- এমন অনেক অভিযোগের বিষয়ে প্রায়ই সংবাদ প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে আসে তাতে যে কেউই চমকে উঠবে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিকট অসংখ্য অভিযোগ জমা হলেও বাস্তবে সেগুলো যথাযথভাবে নিস্পত্তি হয় না।

তথ্য মতে, মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো চিকিৎসা। কিন্তু এই মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এমনকি চিকিৎসকদেরকেও হয়রানি করা হয়। অনেক মানবিক চিকিৎসক হয়রানির শিকারও হন। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু অনৈতিক চিকিৎসকের কারণে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবার বাণিজ্যকীকরণ নিয়েও অনেক তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারি। এর বিপরীতে চিকিৎসা সেবার বাণিজ্যিকীকরণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস, ব্লাডব্যাংক এবং সিসিইউ, আইসিইউর নামে চলছে অনৈতিক বাণিজ্য।

সূত্র জানায়, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। একদিকে বড় বড় সরকারি হাসপাতালের পেছনে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে; অন্যদিকে রোগ নির্ণয় এবং সার্জিক্যাল অপারেশনের জন্য নামসর্বস্ব, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালালরা সরল সাধারণ রোগীদের সেখানে যেতে বাধ্য করছে। মোটা অংকের মাসোহারা বা কমিশন বাণিজ্যের লোভে একশ্রেণির চিকিৎসকরা এসব চক্রের সাথে জড়িত থাকার অসখ্য অভিযোগ রয়েছে।

ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, রোগীর তুলনায় দেশের হাসপাতালে শয্যা, চিকিৎসক, নার্সের সংখ্যা কম। সেবা নিয়ে রয়েছে অনেকের অভিযোগ। কিছু বেসরকারি হাসপাতাল সেবার নামে ব্যবসা করছে। এসব কারণে আস্থার সংকটে অনেক রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যায়। এখন মানুষ বেড়াতে, বিয়ের বাজার করতে, কেনাকাটা করতে দেশের বাইরে যায়।  তিনি বলেন, উচ্চবিত্তরা নিয়মিত চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুর, আমেরিকা যান। মধ্যবিত্তরা ভারত, থাইল্যান্ড যান চিকিৎসার জন্য। এর মানে এই নয় যে, এখানে ফাঁকা করে সব রোগী চলে যাচ্ছেন। কিছুটা আস্থার সংকট তো আছেই। চিকিৎসকদের ওপর অবিশ্বাস, কিছু ভুল রিপোর্ট আসে, এগুলোও কারণ। যখন আস্থার অভাব হয়, তখন আমাকে দিয়ে তো চিকিৎসা করাবে না। মানুষের প্রাচুর্য বাড়ছে, সামর্থ্য বাড়ছে। সামর্থ্য বাড়লে মানুষ ভালো মানের সেবা খুঁজবে। তবে দেশের বাইরে সেবা নিতে গিয়ে অনেকের খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কিছু সমস্যা তো আছেই। কিছু কিছু প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসক বানাচ্ছে। এতে মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। অবকাঠামো, জনবল ও সেবার মান না বাড়ালে মানুষের আস্থা ফেরানো যাবে না।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ