ঢাকা, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

বাংলাদেশে ভারতের প্রকল্প, চুক্তি বা সমঝোতা পুনর্বিবেচনা হবে!

সরোবর  ডেস্ক

 প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২৪, ০৯:১২ রাত  

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দেড় দশকে ঘুরেফিরে যে দেশের নাম সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে সেটি প্রতিবেশী দেশ ভারত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সাল থেকে ছয় বছরের মতো ভারতেই কাটিয়েছেন। এখনও তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে তিনি গিয়েছেনও ভারতেই। কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের সাথে যেসব চুক্তি বা প্রকল্প ভারতের রয়েছে, তার বাস্তবতা ঠিক কী দাঁড়িয়েছে? সেগুলোর ভবিষ্যৎই বা কী?

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে ভারতে একটা অস্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। বহু দিনের মিত্র হলেও এখন নির্বাসিত অজনপ্রিয় নেতাকে আশ্রয় দেয়া, আবার বাংলাদেশের সাথে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্পর্ক–এসব বিষয় ভারতের জন্য এখন ভাবনার বিষয়। কিন্তু, বাংলাদেশের সাথে ভারতের অনেক ধরণের প্রকল্প, চুক্তি এবং সমঝোতা রয়েছে।আর গত ১৬ বছরে ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে কাজ করা যতটা সহজ ছিল, এখন সেটি কতটা থাকবে - তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা।

চুক্তির বিস্তারিত তথ্য জানা যায় কতটা?: আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে কী কী চুক্তি হয়েছে, তার সংখ্যা এবং ধরন বা শর্ত নিয়ে পরিষ্কার তথ্য কমই জানা যায়।এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও সরকারি ওয়েবসাইট কিংবা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না।

ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সাথে বাংলাদেশের অন্তত ২০ টি চুক্তি ও ৬৬ টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সহযোগিতা এবং আগের চুক্তির পরিসরও বাড়ানো হয়েছিল এ সময়ে। তবে এসব চুক্তির শর্তাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাবলিকলি ডোমেইনে পাওয়া যায় না। এছাড়া সমঝোতা স্মারক পরবর্তীতে চুক্তিতে রূপান্তর হয়েছিল কী-না, সেটাও পরিষ্কার জানা যায় না।যেমন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার নিয়ে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক থাকলেও, এ নিয়ে ২০১৮ সালে হওয়া চূড়ান্ত চুক্তির নথি বা তথ্য সরকারিভাবে কোথাও নেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব ভারত পেয়েছে-এমন খবর চীন ও ভারতের গণমাধ্যম থেকেই এসেছে। বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষের তরফে এর বিস্তারিত জানানো হয়নি। এসব নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা সময়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে এসেছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, তিনি মনে করেন দুই দেশের মধ্যকার চুক্তিগুলো পর্যালোচনা হওয়া দরকার। কয়েকটা চুক্তির বিষয় যেটা পাবলিকলি চলে আসছে, যতটুকু আসছে ততটুকুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। আর যতটুকু আসে নাই, সেটা তো আমরা জানি না। এখন আমি নিশ্চিত এই চুক্তিগুলো জনগণের সম্মুখীন হবে।

তিনি বলেন, আমি শুধু ভারতের কথা বলবো না। অনেকগুলো দেশের সাথে বিভিন্ন চুক্তি হয়েছে। সেগুলো রিভিউতে আসা দরকার। কারণ দিনের শেষে এই টাকা তো বাংলাদেশের জনগণকে পে করতে হচ্ছে। এবং এগুলোকে আমরা এড্রেস করতে হবে। এগুলো এড্রেস না করা হলে ভবিষ্যতে তো আরো এরকম চুক্তি হবে।

সবশেষ, জুন মাসে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল করিডোর সমঝোতা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানি গ্রুপকে বাড়তি সুবিধা দেয়া, বেশি খরচ, ক্যাপাসিটি চার্জের মতো দিকগুলোও দেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখেন অনেকে। এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও ছিল সমালোচনা।
এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করে তরুণ প্রজন্মও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা মনে করেন তেমনটাই।

তিনি বলেন, ২০০৮ এর নির্বাচনটা বাদ দিলে বাকি তিনটা নির্বাচনেই কিন্তু ভারত সরকারকে নানাভাবে খুশি করে এবং দেখে যাচ্ছে নিজের ক্ষমতাটাকে দীর্ঘায়িত করার একটা বাসনা আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল। সেই জায়গা থেকে এমন চুক্তিগুলোই এখানে হয়েছে যেখানে বাংলাদেশ কোনোভাবে লাভবান হয়নি। এবং লাভের যে ভাগ সেটার পুরোটাই আসলে ভারতের পকেটে গেছে। সেই চুক্তিগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারের নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে এখন।

প্রতিটি চুক্তি ও সমঝোতা ‘রিভিজিট’ করা হবে:  বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে হওয়া চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে কী-না সে প্রশ্ন জবাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন বলেছেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজের জন্য কিছুটা সময় দরকার।

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, এখন আসলে এমন একটা পরিস্থিতি চলছে যে, যতটা সম্ভব সরকারকে পুরোপুরি সচল করে তোলা। এর পরের পর্যায়ে খুব তাড়াতাড়ি আমরা সবগুলি নিয়ে বসবো-কোন কন্ট্রাক্ট কীভাবে করা যায়। এবং আমরা ট্রান্সপারেন্সিতে (স্বচ্ছতায়) বিশ্বাস করি, যা যা কিছু সম্ভব বা চুক্তি যেগুলো মানুষের জানার অধিকার আছে, সেগুলো আমরা অবশ্যই পাবলিক করবো।

তবে, ভারত এবং বাংলাদেশের প্রকল্প বা চুক্তিগুলো নিয়ে একটা বড় সমালোচনার জায়গা হলও বাংলাদেশের স্বার্থের জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে না পারা।যেমন তিস্তা বা ফারাক্কার মতো ইস্যু, সীমান্ত হত্যা অথবা নেপাল-ভুটানের সাথে সরাসরি যান চলাচলের মত অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি বলে মনে করেন অনেকে।কিন্তু যেসব চুক্তি এর মধ্যে হয়ে গেছে, সেগুলো থেকে কি পেছানোর সুযোগ আছে? সেসব চুক্তি কি পুনরায় বিবেচনা করা হতে পারে?

বিবিসি বাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হোসেন বলেছেন, প্রতিটি চুক্তি ও সমঝোতা ‘রিভিজিট’ অর্থাৎ পুনর্বিবেচনা করা হবে।তিনি বলেছেন, প্রত্যেকটা জিনিস আমরা রিভিজিট করবো, এবং পরীক্ষা করে দেখবো আমরা কোন কোনখানে রিনেগোশিয়েট (নতুন করে সমঝোতা) করতে পারি। বা আমাদের স্বার্থ যেখানে রক্ষিত হয় নাই বলে মনে করি, সেটা নিয়ে যেন আমরা এগোতে পারি। তবে বিষয়টা হলো যে আমাদের প্রত্যেকটাই পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, কোনখানে আমাদের পক্ষে রিনেগোশিয়েট করা সম্ভব এবং কোনখানে সম্ভব না, সে অনুযায়ী আমরা এগোবো।

চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ কি আছে?: ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে ভারত অতি মাত্রায় শুধু আওয়ামী লীগের উপরই নির্ভর করেছে। যে কারণে এখন তাদের জন্য আগের মতো সহজ পরিবেশটা আর নেই। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকবেই।

কিন্তু সেটা সামনের দিনে ঠিক কেমন হবে এবং এখন কী ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে সেটা পরিষ্কার হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলছেন, যেসব চুক্তি নিয়ে সমালোচনার জায়গা রয়েছে তা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ কতটা রয়েছে-সেটা নির্দিষ্ট চুক্তিতে কী আছে, তার ওপরই নির্ভর করে।

সাধারণত সমঝোতা স্মারকের আইনগত বাধ্যবাধকতার জায়গা থাকে না, যা চুক্তির ক্ষেত্রে থাকে।তিনি বলছিলেন, যখনই একটা চুক্তি সম্পাদন করা হয়, তখনি কিন্তু তাতে লেখা থাকে যে কোনও একটা পার্টিকুলার পরিস্থিতিতে এ চুক্তিটা প্রযোজ্য হবে না কারো জন্যই। আরও যেমন এক্সিট ক্লসে থাকে যে, যদি এখানে কোনও ধরণের এক্সট্রা অর্ডিনারি সিচুয়েশন হয় তাহলে এটা কারো ওপরেই অ্যাপ্লিকেবল হবে না।

অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, প্রত্যেকটা চুক্তিতে বিভিন্ন ধরণের এক্সিট ক্লস থাকে। তো ভারতের সাথে যে চুক্তিগুলো করা হয়েছে, এটার এক্সিট ক্লসগুলো কী আছে - সেগুলো খুব কেয়ারফুলি (সতর্কভাবে) দেখতে হবে। যদি এক্সিট ক্লস ফেভারেবল (অনুকূলে) না থাকে, তাহলে কিন্তু সেই চুক্তিগুলো চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এমই