ঢাকা, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ৭ চৈত্র ১৪৩১

সরকার পতনে সংকটে আওয়ামীপন্থি শিল্পীরা

সরোবর প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৫, ০৮:৩১ রাত  

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা ১০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ। তবে গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে খোঁজ নেই তার। অথচ তার অভিনীত বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে।

শুধু ফেরদৌস একা নন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিপদে পড়েছেন আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত অভিনয় ও গানের শিল্পীরা। কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন তাদের কেউ কেউ। তাদেরও এখন 'আওয়ামী লীগের দোসর' হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

এসব কারণে অনেকেই আবার চলে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এর মধ্যেই আবার কেউ কেউ ফেরার চেষ্টা করছেন কাজে।

গত সাড়ে পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিনোদন অঙ্গনের অনেক শিল্পীই নিজেদের নাম লিখিয়েছিলেন ওই দলে। দলীয় পরিচয়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন নানা সুযোগ-সুবিধা, পেয়েছিলেন দলীয় পদ-পদবিও।

অনেকেই আওয়ামী লীগের আমলে বির্তকিত তিনটি নির্বাচনি প্রচারণায়ও অংশ নেন। ফেরদৌসের মতো বেশ কয়েকজন শিল্পী সরাসরি অংশও নেন জাতীয় নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত আসনের এমপিও হয়েছেন কয়েকজন।

গত পাঁচই অগাস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তাদের অনেকেই এখন বলতে গেলে একঘরে হয়ে পড়েছেন। পেশাগতভাগে কোণঠাসা হয়ে পড়ার অভিযোগ তাদের।

যদিও পুরো বিনোদন অঙ্গনেই এখন কাজ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। এ কারণে কলাকুশলীদের একটি অংশ ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন বলেও জানা গেছে।

বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।

কেউ আড়ালে, কেউ বিদেশে
ফেরদৌসের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী অভিনেতা রিয়াজ আহমেদ। দুজন বেশ কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফেরদৌসের মতো খোঁজ নেই রিয়াজেরও। ফোন কিংবা সামাজিক মাধ্যমেও উপস্থিতি নেই তার।

অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা ছিলেন আওয়ামী সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। সংগীত শিল্পী মমতাজও ছিলেন সংসদ সদস্য।

বর্তমান সময়ে বিনোদন মাধ্যমে কাজের অবস্থা নিয়ে বেশ কয়েকবার অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া দেননি। বন্ধ রয়েছে গায়িকা মমতাজের মোবাইল ফোনও।

এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অভিনেত্রী নিপুন আক্তার প্রকাশ্যে আসছেন না পাঁচই অগাস্টের পর থেকে। যদিও বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে তার পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির এক নেতার প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে।

সেটি নিয়ে ওই সময়ও সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন এই অভিনেত্রী। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সেটি আরও প্রকাশ্যে আসে।

'মুজিব: একটি জাতির রূপকার' সিনেমায় শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। তিনি প্রতীকী অর্থে এক টাকা সম্মানি নেন ওই সিনেমার জন্য।

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়, শেখ হাসিনা সরকারের তরফ থেকে রাজধানীর পূর্বাচলে তাকে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকার পতনের পর ওই প্লট বাতিলের আলোচনা ছড়িয়ে পড়লেও বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

অগাস্টের পর থেকে তাকে নতুন কোনো কাজের খবর দিতে দেখা যায়নি। দেশে নতুন কোনো চলচ্চিত্র বা সিনেমায়ও দেখা যায়নি শুভকে। তবে তার অভিনয় করা বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র আছে মুক্তির অপেক্ষায়।

আরিফিন শুভ জানিয়েছেন, বর্তমানে ভারতে একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।

ওই একই সিনেমা, 'মুজিব: একটি জাতির রূপকার'-এ অভিনয়ের জন্য পাঁচই অগাস্টের পর সমালোচনার শিকার হন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীও। তবে তিনি সামাজিক মাধ্যমে মাঝেমধ্যে পোস্ট করেন।

একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, পাঁচই অগাস্টের পর তিনি ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট ও দু-একটি নাটকে অভিনয় করেছেন।

কাজ কি কমেছে?
দেশে কাজের সুযোগ কমে আসায় এরইমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বেশ কজন শিল্পী। যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাদের কয়েকজন বিবিসি বাংলার কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও তাদের কয়েকজনকে সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই বর্তমান সরকারকে সমালোচনা করে পোস্ট দিতে দেখা যায়।

দেশে অবস্থান করা শিল্পীদের কয়েকজনও নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।

শিল্পীদের কাজ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, 'কাজ কমে গেছে বিষয়টা সঠিক নয়, সামগ্রিকভাবে কাজের সুযোগই কমে গেছে। আর কেউ যদি দেশের বাইরে চলে যায় সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'

এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মূলত ঈদকেন্দ্রিক হয়ে গেছে উল্লেখ করে মিশা সওদাগর বলেন, 'আমি যেহুতু বাণিজ্যিক সিনেমার শিল্পী, তাই বলতে পারছি বাণিজ্যিক সিনেমা হয়ে গেছে ঈদকেন্দ্রিক। সারা বছর জুড়ে কাজ কম হচ্ছে।'

গত বছরের জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অভিযোগ ওঠে একদল শিল্পীর বিরুদ্ধে। তারা ওই সময় 'আলো আসবেই' নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত ছিলেন। যারা সবাই আওয়ামীপন্থি বলে সমালোচনা রয়েছে।

পাঁচই অগাস্টের পর গ্রুপের বিষয়টি প্রকাশ পায়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গ্রুপের স্ক্রিনশটগুলো। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তাদের অবস্থানের কারণেও সমালোচনার শিকার হন তারা।

এই কারণে এই গ্রুপের অনেক শিল্পী আর কাজে ফিরতে পারেননি বলে মনে করেন অনেকে। গ্রুপে যুক্ত ছিলেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় বিবিসি বাংলার। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন অভিনেত্রী বলেন, 'যখন গ্রুপের স্ক্রিনশটগুলো প্রকাশ্যে আসল, তখন অনেকের মনেই আমাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।'

তবে ফাঁস হওয়া হোয়াটসগ্রুপের স্ক্রিনশটে শিল্পীদের ফোন নম্বর ছিল। সেটা প্রকাশ পাওয়ায় বিপাকে পড়েন শিল্পীরা। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন কল তাদের বিব্রত করে। এ কারণে অনেক শিল্পীই ফোন নম্বর বদলে ফেলেছেন। এটাও কাজ কমে যাওয়ার একটা কারণ বলে মনে করেন অনেকেই।

আলো আসবেই গ্রুপে থাকা শিল্পীদের মধ্যে সরকার পতনের পর কানাডায় পাড়ি জমান শিল্পী অরুণা বিশ্বাস। আমেরিকায় অবস্থান করছেন অভিনেতা জায়েদ খান, সায়মন সাদিক, সাজু খাদেমসহ অনেকেই।

এই গ্রুপে যুক্ত ছিলেন অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তবে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পাঁচই অগাস্টের পর তাকে শিল্পকলা থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে।

বর্তমানে অভিনেত্রী হিসেবে কাজ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, শিল্পী তো শিল্পীই। তার আবার আওয়ামী সমর্থিত, আর বিএনপি বা জাতীয় পার্টি সমর্থিত কী? একজন শিল্পী তার দেশের। তবে হ্যাঁ, সব মানুষেরই ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দর্শন থাকতে পারে। সেটার সাথে তার শিল্পী সত্তা সাংঘর্ষিক না।একটা দেশে ভিন্ন মত থাকবে, ভিন্ন ধর্ম থাকবে, ভিন্ন রাজনীতি থাকবে এবং সবাই সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।

সরকার পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে দেখলাম আমাদের শিল্পীদের মধ্যে নানারকম গ্রুপিং, রেষারেষি, হিংসা, বিদ্বেষ যা সত্যি দুঃখজনক । বিশেষ করে আওয়ামী ঘেঁষা শিল্পীরা একেবারেই কোণঠাসা। নানা রকম আইনি হয়রানি ছাড়াও তারা নানা কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিয়ে শঙ্কিত।

তিনি দাবি করেন, আমাকে একটা রানিং সিরিয়াল থেকে বাদ দিয়েছে এবং একটা সিনেমা প্রাথমিক কথাবার্তা ফাইনাল হওয়ার পরও টিমের কারও কারও আপত্তির কারণে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

জ্যোতিকা জ্যোতি আরো বলেন, 'শুনলাম নাম ধরে ধরে লিস্ট করে বিভিন্ন চ্যানেলে, মন্ত্রণালয়ে, এজেন্সিতে পাঠানো হয়েছে যাতে তাদের (সুনির্দিষ্ট কিছু শিল্পীদের) কোনো কাজে না নেওয়া হয়। সম্প্রতি টেলিভিশন প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিইয়েশনের পিকনিক হয়েছে। আমরা সবসময় এই পিকনিকে গিয়েছি, সারাদিন আনন্দ করে কাটিয়েছি। এবার বেছে বেছে কয়েকজন শিল্পীকে দাওয়াত দেয়া হয়নি, আমিও তাদের একজন।'

তবে ৫ অগাস্টের আগেও জ্যোতিকা জ্যোতিকে খুব একটা অভিনয়ে দেখা যায়নি। তিনি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকতেন বলে অভিমত কারও কারও।

আলো আসবেই গ্রুপে না থেকেও সমালোচিত হয়েছেন উপস্থাপন ও অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়। একটি পুরনো চিঠির সূত্র ধরে তিনি আলোচনায় আসেন।

২০১৪ সালে প্লট চেয়ে দেওয়া চিঠিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ নেত্রী' ও 'আদর্শ মা' বলে সম্বোধন করেন জয়। সেই চিঠি পাঁচই অগাস্টের পর আবার ভাইরাল হয়।

পুরো চিঠিতে তিনি অসংখ্যা বার শেখ হাসিনাকে মা ডাকেন। অভিযোগ রয়েছে, সেই চিঠির সূত্র ধরে তিনি প্লটও পেয়েছিলেন।

বর্তমানে শিল্পীদের কাজ কমছে কিনা জানতে চাইলে শাহরিয়ার নাজিম জয় বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিল্পীদের কাজের সুযোগ কমেছে বা কমবে বলে আমি মনে করি না। সামগ্রিকভাবেই কাজ একটু কম হচ্ছে। তবে কিছু কিছু শিল্পী রাজনৈতিকভাবে এতটাই সক্রিয় ছিল যে তারা দর্শক থেকে অনেক দূরে সরে গেছে এবং খুবই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।'

তিনি আরও যুক্ত করে বলেন, 'এমতাবস্থায় নির্মাতা এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সেই সব শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। অন্যদিকে গুণী গুণী শিল্পীরা অনেকেই এই তালিকায় আছেন, তাদের ছাড়া এই ইন্ডাস্ট্রি আরও থমকে পড়বে।'

সাবেক সরকারের পক্ষে থাকা শিল্পীদের ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন কিনা সেই প্রসঙ্গে শাহরিয়ার নাজিম জয় বলেন, 'আমি শিল্পীদের বলেছিলাম যে যার ভুলের জন্য ক্ষমা চাক, মানুষ ভুল করে এবং মানুষই ক্ষমা চায়। সামান্য একটু ক্ষমা চাইলেই সকল শিল্পী কাজ করার সুযোগ পেতো। কিন্তু আমার কথাটা অনেক শিল্পী গ্রহণ করে নাই কিংবা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে।'

কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে?
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নিতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন পরিচিত বেশ কয়েকজন শিল্পী। 'তৌহিদি জনতা'র ব্যানারে তাদের শোরুম উদ্বোধন থেকে শুরু করে নানা রকম পণ্যর প্রচারণামূলক কাজে বাধা দেয়া হয়েছে।

এমনকি কোথাও কোথাও আয়োজিত কনসার্ট পণ্ড করার ঘটনাও ঘটেছে।

এসব নিয়ে অনেকেই মুখ বন্ধ রেখেছেন, কথা বলছেন যারা তারা সংখ্যায় কম।

কাজে বাধা ও কাজ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে নুসরাত ফারিয়া কদিন আগে গণমাধ্যমকে বলেন, এটা আসলে খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। আমার কাছে মনে হয় যে এরকমটা হওয়া ঠিক না। কারণ আমাদের দেশের সংস্কৃতিটা আমাদেরকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই জিনিসটা বন্ধ হয়ে গেলে আর্টিস্টরা কী করে খাবে!

দৈনিক সরোবর/এএস