সংস্কার: অস্পষ্টতা দূর করতেই সময় নিয়েছে বিএনপি
প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২৫, ০৮:৪৯ রাত

সংস্কারের বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে চিঠি দিয়েছে, তার উত্তর দিতে সময় চেয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, যে ফরম্যাটে মতামত চাওয়া হয়েছে তা যথাযথ নয়। শুধু টিক মার্ক দিয়ে মতামত দিলে অস্পষ্টতা থাকবে। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। তাই বিস্তারিতভাবে মতামত দেওয়ার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে।
শুধু বিএনপি নয়, আরো ১৫টি রাজনৈতিক দল পূর্ণাঙ্গ মতামত দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত কয়েক দিন সময় চেয়েছে। তবে এরই মধ্যে মতামত জমা দিয়েছে ১৫টি দল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয় গত ১২ ফেব্রুয়ারি।
পাঁচটি সংস্কার কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ১৬৬টি সুপারিশ জমা দিয়েছে, সে বিষয়ে মতামত জানতে বিএনপিসহ মোট ৩৭টি রাজনৈতিক দলের কাছে গত ৬ মার্চ চিঠি দেয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মতামতের জন্য যে ছক করা কাগজ (স্প্রেডশিট) দেওয়া হয়েছে, তাতে মতামত দিলে স্পষ্ট হওয়া যাবে না। বরং বিভ্রান্তি ছড়াবে। সে কারণে আমরা আপত্তি জানিয়েছি। বলেছি, বিস্তারিত আকারে আমরা মতামত জানাবো। তার জন্য দু-একদিন সময় চেয়েছি। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে মতামত জানাবো।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যেটা না করলেই নয়, সেগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসেও সংস্কার এবং নির্বাচনের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, সংস্কারের মতামতের জন্য সময় চাইতেই পারে রাজনৈতিক দল। তবে কতটুকু সময় চেয়েছে সেটি বিষয়। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা যত বেশি হবে ততটাই উত্তম পথ বেরিয়ে আসবে। দু’এক সপ্তাহ কোনো বিষয় নয়, এটা লাগতেই পারে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যে দলগুলো মতামত জানিয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামা ইসলাম বাংলাদেশ, জাকের পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ও আমজনতার দল।
মতামত জানানো দলগুলোকে নিয়ে বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) থেকে আলোচনায় বসবে ঐকমত্য কমিশন। জাতীয় সংসদ ভবনে এ আলোচনা হবে। কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় এলডিপির সঙ্গে আলোচনায় বসার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য দলের সঙ্গেও আলোচনার সময়সূচি ঘোষণা করা হবে। আর পরে যারা মতামত দেবেন, ক্রমান্বয়ে তাদেরও আলোচনার জন্য কমিশন আমন্ত্রণ জানাবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গত সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুইটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।
প্রথমটি হলো-সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো ‘একমত’, ‘একমত নই’ ও ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়টি হলো-প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ ও ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যে কোনো একটিতে টিকচিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
সংস্কার কাজের প্রেক্ষাপট: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের। জুলাইতে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে তা দমনে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে এক হাজার ৪শর বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর চালানো সামরিক অস্ত্র ও শটগানের গুলিতে মারা যান। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। অনেকের দুই চোখ, কারো কারো এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ১১ হাজার সাতশর বেশি মানুষকে র্যাব ও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
হাসিনার সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। যেন জনপ্রশাসন, পুলিশ, সংবিধান বা আদালতকে ব্যবহার করে কেউ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট না হয়ে উঠতে পারে এবং ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে যেন লুটপাট বন্ধ করা যায়, সেজন্য এই সংস্কারের দাবি তোলে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-জনতা।
৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে ১২ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদী ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই কমিশনের সহসভাপতি। এছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন এবং পুলিশ সংস্কারবিষয়ক কমিশনের প্রধানরা ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
দৈনিক সরোবর/এএস