ঢাকা, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৯:১৪ রাত  

ঢাকা শহরে নতুন দানব রূপে আবির্ভূত হয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। একটা সময় অলিগলিতে চললেও এখন এসব রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো। বাস-ট্রাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। এমন কি কোথাও কোথাও ফ্লাইওভারেও চড়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই ছুটছে উল্টো পথে। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা। ট্রাফিক পুলিশসহ প্রশাসন যেন অনেকটা অসহায়। নানা উদ্যোগ নিয়েও রুখতে পারছে না এসব যানবাহনকে। 

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমন্ডি ১৫ নাম্বার থেকে ১৫ নাম্বার মিনা বাজারের দূরত্ব আনুমানিক ৩০০ মিটার। আর মিনা বাজার থেকে ধানমন্ডি ৯/এ এর দূরত্ব প্রায় ৪০০ মিটার। কাছাকাছি স্থানে দুটি ইউটার্ন থাকার পরও অটোরিকশাকে উল্টো পথে চলতে দেখা গেছে। এতে পথচারী ও যাত্রীরা প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

একই অবস্থা দেখা যায় ফার্মগেটের খামার বাড়ি সিগন্যালেও। এখানে সোজা পথে বিজয় সরনি যেতে চাইলে সংসদ ভবনের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু অটোরিকশাগুলো তা না করে উল্টো পথে চলছে। এই সিগন্যালে একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স থাকলেও এখানকার ট্রাফিক পুলিশদের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নজরে আসেনি। এমন দৃশ্য রাজধানীর প্রায় সব এলাকার। 

সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) উল্টো পথে চলাচল করলে ব্যবস্থার বিষয়ে এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেখানে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে সকল যানবাহন চালকদের যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন মান্য করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ভঙ্গকারী সরকারি যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জোরদার করা হবে। তবে তা শুধু কাগজে কলমে রয়েছে। সরেজমিনে কোনো পদক্ষেপ মেলেনি। বরং প্রশাসনের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে। 

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দাপট বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এতে যেমন যানজট বেড়েছে তেমনি দুর্বল ব্রেকিং সিস্টেম হওয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকায় অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এতে আন্দোলনে নামেন অটোরিকশা চালকেরা। আন্দোলনের মুখে আদালত সে আদেশ এক মাসের জন্য স্থগিত করেন। কিন্তু মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও এই নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। 

অটোরিকশার দুর্ঘটনার কবলে পড়া সোহেল বলেন, স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে ডাক্তার দেখাতে বের হলে উল্টো পথে এসে একটি অটোরিকশা আমাদের ধাক্কা দেয়। এতে আমরা দুজনেই মারাত্মকভাবে আহত হই। কিন্তু সেই রিকশার ড্রাইভার এমনভাবে মিনতি করে যে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা যায় যখন আমার গাড়ি অটোরিকশার সঙ্গে সামান্য ধাক্কা খায়। সেসময় তাদের চরিত্র দানব আকার ধারণ করে। তাদের দোষ হলে তারা আপনার হাতে পায়ে ধরবে, কিন্তু আপনার সামান্য পরিমাণ দোষ হলে তারা আপনাকে মারতে পর্যন্ত তেড়ে আসবে। এমনকি মেরে দিতেও পারে।

এ বিষয়ে কথা হয় আজমীর নামের এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ভাই ঢাকা শহরে এখন কম দূরত্বে যাওয়া একমাত্র বাহন হলো অটোরিকশা। আপনি যদি মনে করেন অটোরিকশায় যাবেন না তাহলে আপনাকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে পায়ে চালিত রিকশার জন্য। ইচ্ছে না থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে আমাদের চড়তে হচ্ছে অটোরিকশায়। সেদিন দেখলাম একটি অটোরিকশা গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যাত্রীসহ উল্টো গেছে। এতে যাত্রী কিছু সময়ের জন্য অচেতন থাকলেও চালকের পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। এসব আমার চোখের সামনে ঘটেছে। এরপরও প্যাডেল রিকশা কম থাকায় আমাদের এ অটোরিকশায় চড়তে হচ্ছে।  

আরেক পথচারী জানান, অটোরিকশার গতি অনেক বেশি থাকে এবং এদের ব্রেকিং সিস্টেমটাও ভালো না। এরা প্রায়ই সময় বাঁচানোর জন্য বেপরোয়াভাবে যাত্রীদের নিয়ে উল্টো পথে চলে। এতে যেমন যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি থাকে তেমনি পথচারী বা অন্য গাড়ির যাত্রীদেরও জীবনের ঝুঁকি থাকে। সামান্য সময় বাঁচানোর জন্য এভাবে উল্টো পথে চলা ঠিক নয়। এছাড়া উল্টো পথে চলার কারণে রাস্তার স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্ন ঘটে, ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।

রাজধানীর আবহনীর মাঠের সামনের প্রধান সড়কে সরেজমিনে গিয়ে উল্টো পথে আসা কয়েকজন অটোরিকশার চালকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সবার বক্তব্য একই ধরনের। চালকেরা জানান, একটু রাস্তা উল্টো না গেলে অনেক রাস্তা ঘুরে আসতে হয়। এতে সময় অনেক লেগে যায়। তাই সামান্য রাস্তা উল্টো পথেই যান তারা।

এদের কারও কারও কাছে উল্টো পথে চলাই যেন নিয়ম। এমনই এক চালক আব্দুর রহিম। অনেকটা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন, উল্টো পথে চললে কী হবে। সবাই চলে। আমিও চলব, এতে আপনার কী? পুলিশ কিছু কয় না হেতে আইছে সাংবাদিক। দুর্ঘটনা যদি অয় আমার হইবো, মরলে আমি মরুম, আপনার কী? যান তো কাজে যান। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ভাই! আমরা কী করব বলেন। কতজনকে ধরে বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এদিকে এদের বেপরোয়া চলাফেরা অন্য দিকে সচেতনতার অভাব। মাঝেমধ্যে মানবিক দিক বিবেচনা করে ছেড়ে দিই। আবার মাঝেমধ্যে কাউকে ধরলে এরা দলবদ্ধ হয়ে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, সে সময় আমাদের কিছু করার থাকে না।

এদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এই ট্রাফিক সার্জন।

অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন-জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, এগুলো তো চলার কথা না। যেখানে বাস চলবে সেখানে এ ধরনের ছোট ছোট গাড়ি চললে যানজট কখনো যাবে না। যে কারণে যেসব বড় বড় রাস্তায় বাস চলাচল করে সে সকল রাস্তায় এ ধরনের ছোট ছোট গাড়ি চলার অধিকার থাকবে না বলে আমি মনে করি।

অটোরিকশার উল্টো পথে চলা বন্ধ করতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার তো চলে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও অক্ষম। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নিবন্ধন দেয়, কে রাস্তায় চলতে পারবে, আর কে চলতে পারবে না। সে দায়িত্বটা তারা ঠিকমতো পালন করে না। তারা শুধু নিবন্ধন দিয়েই যায়। সরকার আসবে সরকার যাবে, থাকবে প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যদি অক্ষম হয়, দুর্বল হয় এবং তাদের যদি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হবে না। 

বিআরটিএ সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ঢাকার জন্য কী পরিমাণ রিকশা থাকলে ঠিক হবে সেটা রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের কোনো সক্ষমতা নাই, কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান নাই এবং কারো কাছে দায়বদ্ধ নয়।

ড. এম শামসুল হক বলেন, আমরা যদি সক্ষম প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে না পারি তাহলে কিন্তু এগুলোর নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে সম্ভব হবে না। এদের সংখ্যা বেশি হলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পুলিশ কয়টা ধরবে, এগুলো তো পরিচালনা যোগ্য নয়।

দৈনিক সরোবর/এএস