ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

আইসিসি’র গ্রেফতারি পরোয়ানায় নত নয় ইসরায়েল 

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৪, ০৮:৫৯ রাত  

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলি সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।

বৃহস্পতিবার এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এটিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে তৈরি কোনো দেশের নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রথম ঘটনা।

আইসিসি বলছে, ক্ষুধাকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য এই দুইজনকে দায়ী করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। দুইজনের প্রত্যেকের অন্যদের সাথে মিলে যৌথভাবে সহ-অপরাধী হিসেবে নিম্নলিখিত অপরাধের জন্য ফৌজদারি দায়বদ্ধতা রয়েছে: যুদ্ধের পদ্ধতি হিসাবে ক্ষুধার ব্যবহার এবং হত্যা, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কাজের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

তবে আন্তর্জাতিক আদালতের এই পদক্ষেপকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘মিথ্যা’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যানও করেন তিনি। দাবি করেন, গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামলার জবাবেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেশটি।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, আইসিসি ইহুদি রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চায় আর ইহুদিবিদ্বেষী এই পদক্ষেপ নেয়াই হয়েছে আমাদের ধ্বংস করতে উদ্যোত শত্রুদের বিরুদ্ধে আমার এবং আমাদের আত্মরক্ষার স্বাভাবিক অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত রাখতে এবং বাধা দিতে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।

যদিও গত জুলাইয়ে এক তাদের এক বিমান হামলায় দেইফের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছিল ইসরায়েল। তবে হামাস আজও এই তথ্য নিশ্চিত করেনি।

ইসরায়েল ও গাজার প্রতিক্রিয়া: দেইফের মৃত্যু নিয়ে দোলাচল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই গ্রেফতারি পরোয়ানাটি কেবল ইসরায়েলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে জানান বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার।

শুক্রবার বিবিসির গ্লোবাল নিউজ পডকাস্টে যুক্ত হয়ে গার্ডনার বলেন, আর আংশিকভাবে সে কারণেই ইসরায়েলি জনতা এবং নেতারা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অন্যদিকে গাজায় কেবল হামাস এবং ইসলামিক জিহাদী গোষ্ঠীই না, সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগ বলছেন, ন্যায়বিচার ও মানবতার জন্য এটি একটি অন্ধকার দিন হয়ে থাকবে। আইসিসির বিরুদ্ধে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের’ অভিযোগও আনেন তিনি। সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। কিছুদিন আগেই নেতানিয়াহু তাকে পদচ্যুত করেন।

‘কারো ভয়ে ইসরায়েল নত হবে না’- উল্লেখ করে নিজের ব্যক্তিগত এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘এই যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে লড়াই চালিয়ে যাবে’।

একই সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন সময়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সংস্থার নেতৃত্ব দেয়ার অসাধারণ সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত এবং ইসরায়েল রাষ্ট্ররক্ষায় নিয়োজিত সর্বোচ্চ পেশাদার এবং নৈতিক সৈন্যদের পাশে রয়েছেন’-বলেও লেখেন তিনি। এদিকে গাজাবাসী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, অবশেষে পৃথিবী তাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

তবে চলমান এসব ঘটনার মধ্যেই গাজায় চালানো ইসরায়লি বিমান হামলায় গত ৩৬ ঘণ্টায় আরো ৭০ জনের মৃত্যুর কথা জানান গার্ডনার। একই সঙ্গে গাজার উত্তরাঞ্চলে খাবার আর ওষুধের অভাবে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান তিনি। নেতানিয়াহু কি গ্রেফতার হবেন?: নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট এবং দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে।

নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত এই আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্দেশ্য ছিল, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের মতো নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা। তবে এটি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে আলাদা। আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই। ফলে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য তারা তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর উপর নির্ভর করে।

এই আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য মোট ১২৪টি দেশ ‘রোম স্ট্যাটিউট’ নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকান, ১৯টি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয়, ১৯টি পূর্ব-ইউরোপীয়, ২৮টি ল্যাটিন অ্যামেরিকান এবং ক্যারিবীয় এবং ২৫টি পশ্চিম ইউরোপীয় ও অন্যান্য রাষ্ট্র রয়েছে।

তবে এটিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইসরায়েল। ইসরায়েল আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় এর ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই বলে দাবি করে দেশটি। তবে বৃহস্পতিবার গ্রেফতারি পরোয়ানা ঘোষণা করার সময় আইসিসি জানায় যে এর সদস্য রাষ্ট্র ‘ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক বিচারিক এখতিয়ারের ভিত্তিতে’ ইসরায়েলের ওপর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

যদিও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আইসিসি সাধারণত অনুপস্থিত আসামিদের বিচার করে না। যার অর্থ দাঁড়ায়, সম্ভবত নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট আইসিসির কোনো সদস্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করা বা গ্রেফতার না হওয়া কিংবা দুজনকে হেগে না আনা পর্যন্ত তাদের বিচারের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই।

ফলে পরোয়ানা জারি হলেও নেতানিয়াহু কিংবা গ্যালান্টকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হবে না। তবে এরপর থেকে তাদের জন্য যেকোনো দেশে ভ্রমণ করা জটিল হবে, একইসঙ্গে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন করার হুমকি তৈরি হলো।

অন্য দেশগুলো যা বলছে: স্বাভাবিকভাবে নেতানিয়াহু আর গ্যালান্ট যদি আইসিসি সদস্যভুক্ত কোনো দেশে পা রাখেন তাহলে তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতের কাছে তুলে দেয়ার কথা। নেতানিয়াহু সবশেষ জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান, যা কি না আইসিসির সদস্যভুক্ত না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ‘আপত্তিজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

‘আইসিসি যা-ই বোঝাক না কেন, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে তুলনার জায়গা নেই’ উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তার হুমকির মুখে পড়লে আমরা সবসময় তাদের পাশে দাড়াবো।’ তবে গত বছর নেতানিয়াহু বেশ কয়েকটি দেশে গেছেন, যার একটি যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যে এলে কি তাকে গ্রেফতার করা হবে?– এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা কোনো পূর্বানুমানে যাব না’। এদিকে খোলাখুলিভাবেই নিজেদের ভূখণ্ডে যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দুই দেশ ইতালি এবং নেদারল্যান্ডস।

নির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ না করলেও আইসিসি-র নিয়ম মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ। ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইইউ'র সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইসিসির সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে ইতোমধ্যে পাশ হওয়া একটি বিল সিনেটে পাশ করার আহ্বান জানিয়েছে রিপাবলিকান নেতা জন থুন। এই বিলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের দ্বারা ‘সুরক্ষিত ব্যক্তিদের তদন্ত, গ্রেফতার, আটক বা বিচারের প্রচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে’।

আগের গ্রেফতারি পরোয়ানাগুলো কীভাবে কার্যকর হয়েছে?: আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশগুলো যে সব সময়ই গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি কার্যকর করে, তেমনও না। যেমন, ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি।

অথচ গত সেপ্টেম্বরে আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশ মঙ্গোলিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেও সেখানে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি বরং সফরের সময় দেশটিতে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। তবে ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সামিটে যাননি মি. পুতিন। সে সময় দেশটির আদালত বলেছিল, পুতিনকে গ্রেফতার করা সরকারের দায়িত্ব। এর আগে দারফুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের জন্য ২০০৯ সালে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি।

তবে ২০১৫ সালে বশির সাউথ আফ্রিকা গেলেও তাকে গ্রেফতার করেনি দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস