ডিসেম্বরেই আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৩, ০৫:০৪ বিকাল

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার (৪.৭ বিলিয়ন) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার আগামী ডিসেম্বরে পাওয়ার প্রত্যাশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফ তাদের বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আগামী ১১ ডিসেম্বর অনুমোদন পেতে পারে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের শেষ বৈঠক হয়েছে। পরে বৈঠক প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।
তিনি জানান, আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত ছিল। এর মধ্যে ৬টি শর্ত নিয়ে কাজ করেছি আমরা। শর্তের বেশ কিছু সফল হয়েছে। কিছু পূরণ হয়নি। তবে শেষ বৈঠকে উভয়পক্ষ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়েছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা যায়, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮১ মিলিয়ন (৬৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার) ডলার আমরা পাবো। আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফ তাদের বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দু’একটি জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণও কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি প্রকাশ করেছে। বিপিএমসিক্স অনুযায়ী, রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া মুদ্রার বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদ হারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে তিনি বলেন, নিট রিজার্ভ সম্পর্কে আমি এখন বুঝতে পারছি না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব সম্পর্কে বলতে পারবো। বিপিএম ৬ অনুযায়ী হিসাব প্রতি সপ্তাহে ওয়েবসাইটে আপলোড করা হচ্ছে।
মেজবাউল হক আরও বলেন, আমরা যে দুই শর্ত পূরণ করতে পারিনি তার একটি নিট রিজার্ভ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়নে রাখা, সেটা হয়নি। অন্যটি হলো রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, বিপরীতে ১৪ হাজার পিছিয়ে রয়েছে আদায়।
আইএমএফের মোট ৪৭০ কোটি বা ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি অনুমোদনের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। ঋণের জন্য বেশকিছু শর্ত দেয় আইএমএফ। এগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ব্যাংক ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী করে প্রকাশ, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, শেয়ারবাজারের উন্নয়নসহ বেশকিছু আর্থিক ও নীতি সংস্কারে মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে।
এর আগে ঋণ আলোচনায় সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি দপ্তর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছিল আইএমএফ। এবার আসা রিভিউ মিশনের প্রতিনিধিরা প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতের নির্বাহীদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেন। আলোচনা শেষে প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আইএমএফ।
এদিকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের আওতায় রিজার্ভ অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ, তা সংশোধনে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের আওতায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, রাজস্ব সংগ্রহ, জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়সহ বেশ কয়েকটি লক্ষ্য শিথিল করেছে।
রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি বিপিএমসিক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। নিট ভিত্তিতে এই পরিমাণ আরও হ্রাস পেয়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করার জন্য আইএমএফকে অনুরোধ করেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। সেই অনুরোধ বিবেচনায় আইএমএফ লক্ষ্য মাত্রা শিথিল করেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষে রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী বছরের জুন শেষে ২০ বিলিয়ন ডলারে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফ মিশন চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারকে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল, সেটিও কমাতে রাজি হয়েছে। তবে সরকারের প্রাইমারি ব্যালেন্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএমএফ।
অর্থনীতিবিদরা ঋণ কর্মসূচির কিছু শর্ত শিথিলে আইএমএফের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, সতর্ক করে বলেছেন, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ছাড়া নতুন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করাও কঠিন হবে। এ বছরের শুরুতে আইএমএফ সেপ্টেম্বর নাগাদ ২৫.৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিট বা প্রকৃত ফরেক্স রিজার্ভ গঠনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু, আইএমএফের রিজার্ভ হিসাব করার পদ্ধতির ষষ্ঠ সংস্করণ বিপিএম৬ (BPM6) অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার। নিট হিসাব করলে এই পরিমাণ আরো কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে আলোচনার পর আইএমএফ কিছু শর্তে নমনীয় হতে সম্মত হয়।
প্রসঙ্গত, আইএমএফ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি ফরেক্স রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৬.৭ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে– ২০২৪ সালের জুন নাগাদ ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ গঠনের নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবে।
এর আগে ৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন আইএমএফের ঋণ পর্যালোচনা মিশনের সদস্যরা। এরপর তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছেন।
ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত হিসেবে, প্রাথমিকভাবে চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৪ লাখ ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল আইএমএফ।
কিন্তু আইএমএফ মিশন সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনি বছরে এই টার্গেট অর্জন কঠিন হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরপর আইএমএফ এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের প্রাইমারি ব্যালেন্সে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ইততোপূর্বে ১ লাখ ৬২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রেখেছিল আইএমএফ, যা এখন ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রাইমারি ব্যালেন্স হচ্ছে, সরকারি ঋণের ওপর নিট সুদ প্রদান ব্যতীত রাজস্বের ভারসাম্য। এক কথায়, এটি হলো সরকারের রাজস্ব আয় এবং সরকারিভাবে পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর পেছনে ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য।
দৈনিক সরোবর/এএস