ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

পাবনায় দুই মাসে নয় খুন

পাবনা প্রতিনিধি

 প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ০৭:৪৩ বিকাল  

পাবনায় খুন, জখম ও রাহাজানি যেন থামছেই না। গত দুই মাসে জেলায় নয় টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে হত্যাকাণ্ডের এ প্রবাহকে স্বাভাবিক দাবি করেছে পুলিশ।

শনিবার (৭ ডিসেম্বর) রাতে পাবনার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চরঘোষপুরে ওয়াজ মাহফিল চলাকালে শিমুল হোসেন (২১) নামের এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। শিমুল পাবনা জিলা স্কুলের ২০২২ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

ঘটনার দিন রাতে মাহফিলের মেলায় মেয়ের জন্য জিলাপি কিনতে যান শিমুল হোসেন। এসময় ওই এলাকার সরদারপাড়া ও সাকার মার্কেট এলাকার দুই গ্রুপের মধ্যকার গন্ডগোল থামাতে গেলে ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে শিমুলসহ তিনজন আহত হন। পরে মারা যান শিমুল। 

এর আগে আত্মসমর্পণ করা চরমপন্থি সদস্য বাকুল মিয়াকে (৪৫) কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে। গত ২৪ নভেম্বর রাতে জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি ইউনিয়নের রাউতি উত্তরপাড়া স্কুলের পাশে এ ঘটনা ঘটে।

জেলা পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ নভেম্বর পাবনা সদর উপজেলা মৎস্যজীবী দলের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক জালাল উদ্দিনকে (৪৫) পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় বাড়িঘর ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটতরাজের ঘটনাও ঘটে। পরদিন ১৭ নভেম্বর রাতে পাবনা শহরে তুষার হোসেন (১৬) নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার পরদিন সকালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকাশ্যে দিবালোকে ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

৮ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে আসিফ হোসেন (৩২) নামের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ২৯ অক্টোবর আতাইকুলার ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম (৪৫) ও তার আগে ১০ অক্টোবর ঈশ্বরদীতে নয়ন হোসেন (২৮) নামের এক যুবককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলার থানাগুলোতে মোট সাতটি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ২০ জন।

হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি জেলায় ব্যাপকহারে বেড়েছে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাট ও অপহরণসহ নানা অপরাধ। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে। প্রকাশ্যে চলছে মাদক কেনাবেচা।

সরকার পতনের পর পুলিশ তেমন সক্রিয় ভূমিকা না নেওয়ায় ভেঙে পড়েছে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। হত্যাকাণ্ডের বাইরেও প্রকাশ্যে বিভিন্ন পয়েন্ট দখল ও চাঁদাবাজি এখন প্রকাশ্য বিষয়। এসব চাঁদাবাজি ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে অনেক সময় গোলাগুলি ও সংঘর্ষে জড়াচ্ছে অনেকেই। গত ৫ ডিসেম্বর জেলার আমিনুপুর থানার সাগরকান্দি ইউনিয়নের গোবিন্দপুরে বিএনপি নেতা পরিচয় দেওয়া তাবিজ ফারুকের ভাতিজা ফারদিন তার চাঁদাবাজির সহযোগী সাইদুরকে গুলি করেন।

তথ্যমতে, চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে এ দ্বন্দ হয়। একপর্যায়ে সাইদুরকে গুলি করেন ফারদিন। এ ঘটনা গোপন রাখতে সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে পাবনার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন সাইদুর। এছাড়া আমিনপুরসহ জেলাজুড়েই বালু উত্তোলন, জলাশয় ও বাজার দখলসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে হামলা, মারধর ও সংঘর্ষসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা।

স্থানীয় রতন মৃধা বলেন, জেলায় কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে গেছে। সন্ত্রাসীদের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে যাচ্ছি। এমন পরিস্থিতি হয়ে যাচ্ছে যে, আমরা সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হতেই ভয় পাচ্ছি।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবিএম ফজলুর রহমান বলেন, যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধীরা আরও উৎসাহী হবে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন এখনো মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। প্রশাসন এখনই লাগাম টেনে না ধরলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে জানান মানবাধিকার কর্মী কামাল আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, অপরাধ ব্যাপক বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে গেছে। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বেড়ে গেছে।

এ বিষয়ে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজিনুর রহমান বলেন, অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সাতটি হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন ২০ জন। প্রত্যেকটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে তিনি জানান, পাবনায় অপরাধের ইতিহাসে মাসে চার-পাঁচ টি হত্যা মামলা রয়েছে। এখনো সেই প্রবাহই রয়েছে। পরপর কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় অনেকেই এতে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও প্রকৃত অর্থে তেমন উদ্বেগের কিছু নেই। পুলিশ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিরলস কাজ করছে।

দৈনিক সরোবর/এসএফ