ভালোবাসার সুরে-ছন্দে বসন্ত বন্দনা
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩, ০৬:১৯ বিকাল

ঋতু বদলের চরাচরে শিমুল-পলাশের রাঙা হাসি, বাতাসে ফিসফাস; রবি ঠাকুর যে বলে গেছেন, ‘আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো’।
ফাল্গুনের প্রথম দিন মঙ্গলবার, এদিনই আবার ভ্যালেন্টাইস ডে, যাকে বাঙালি বলে ‘ভালোবাসা দিবস’। নবযৌবনের ঋতুকে বরণ করে নিতে ফাগুনের প্রথম প্রভাতে তাই উৎসব।
বাসন্তী সাজে নর-নারী মেতেছে আনন্দে; রাজধানীর শাহবাগ, চারুকলা, টিএসসি, পাবলিক লাইব্রেরি আর উদ্যানে উদ্যানে ফুল আর ভালোবাসার রঙ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সকালে নাচ, গান, আবৃত্তি ও বসন্ত কথনে শুরু হয় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর দিনব্যাপি আয়োজন। বকুলতলা ছাড়াও পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণি রোডের বঙ্গবন্ধু উন্মুক্ত মঞ্চে রয়েছে এবারের বসন্ত উৎসবের আয়োজন।
চারুকলার বকুলতলায় সকাল সোয়া ৭টায় বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পীদের সমবেত যন্ত্রসংগীতে রাগ-বিহার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। পরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা নানান পরিবেশনায় অংশ নেন।
৫ বছরের মেয়ে শায়ন্তনিকে নিয়ে আজিমপুর থেকে বসন্ত উৎসবে এসেছিলেন রুহুল আমিন ও সুরভি দম্পতি। রুহুল আমিন বললেন,“আমাদের মেয়ে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠুক, আমরা এটা চাই। এজন্যই বসন্ত উৎসবে নিয়ে এসেছি। ঢাকা শহরে থেকে আমরা আসলে নিজস্ব উৎসব, পার্বণ সবই তো ভুলে যাচ্ছি। তবুও চেষ্টা করি মেয়েকে এগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। সময় পেলেই মেয়েকে গ্রামে নিয়ে যাই, যাতে আমাদের শেকড় সম্পর্কে ওর ধারণা জন্মে।
বসন্ত কথন পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, সংস্কৃতির যে আবহমান ধারা, তারই প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন পার্বণে আর এ ধরণের উৎসবে। আজকে বসন্ত উৎসবে যেভাবে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একত্রিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্রই ফুটে উঠছে। বসন্ত উৎসবের অসম্পদায়িক রূপ আবহমান বাংলার একটি চরিত্র, এটি আরও বেশি ছড়িয়ে দেয়া জরুরি।
অনুষ্ঠানের সভাপতি, বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর আহ্বায়ক স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষের মাঝে মানবিকতার চর্চা যেন আরও বৃদ্ধি পায় তার জন্যই প্রতি বছর বসন্ত উৎসব উদযাপন করছি আমরা। এই উৎসবের মধ্যদিয়ে আমরা মানবিকতার জয়গান শোনাই এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাই।
বসন্ত কথন পর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কাজল দেবনাথ ও মানজার চৌধুরী সুইট। আর পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আহসান উল্লাহ তমাল ও নুসরাত ইয়াসমিন রুম্পা।
বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ এর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, তার মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ থেকে আমরা মনে হয় একটু একটু করে সরে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথকে বহমান রাখতে হলে সংস্কৃতির পথ ধরেই আমাদের হাঁটতে হবে। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বসন্ত উৎসবের মত উৎসবগুলো যত বেশি উদযাপন করব, আমরা নিজেদের শেকড়কে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাব।
দর্শক সারিতে হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রী: মঞ্চে চলছিল বসন্ত কথন পর্ব। এ সময় হঠাৎ দেখা গেলো দর্শক সারিতে খুব সাধারণ বেশে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। পাশে থাকা এক নারী মন্ত্রীকে চিনতে পেরে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলেন, এরপরই দর্শক সারিতে খবর রটে গেল, মন্ত্রী এসেছেন।
মঞ্চ থেকে মাইকে অনুরোধ করা হল মন্ত্রীকে মঞ্চে গিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য। মঞ্চে গিয়ে দীপু মনি কেবল বললেন, ‘সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা, অনেক ভালোবাসা।’ ফের চলে গেলেন দর্শক সারিতে।
গণমাধ্যমকর্মীরা এসময় বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস নিয়ে মন্ত্রীর কথা শুনতে চাইলেন। দীপু মনি বললেন, প্রতি বছরই বসন্ত উৎসবে আসার চেষ্টা করি। আজকেও এলাম। এই বসন্ত আমাদের চেতনার সাথে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। মন্ত্রীকে ঘিরে বাড়তে থাকে সেলফি তোলার ভিড়। সেই ভিড় এক সময় বিড়ম্বনার রূপ নেয়। মন্ত্রীর মুখের হাসিতে মিশে যায় একটুখানি বিরক্তি।
গাড়িতে ওঠার আগে দীপু মনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বিরক্ত হচ্ছি না। তবে আমি অনুষ্ঠান উপভোগ করতেই এসেছিলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অনুষ্ঠান দেখেছি। এখানে অনেক তরুণরা আসে, সবার এই আনন্দিত চেহারাটা দেখতে ভালো লাগে। আরও কিছু সময় থাকতে পারলে ভালো লাগতো। আমার আরেকটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। এজন্য বেরিয়ে যাচ্ছি।
গান, নাচ ও আবৃত্তিতে জমজমাট অনুষ্ঠান:সকালের পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বসন্ত' কবিতা আবৃত্তি করেন একুশে পদকজয়ী আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। কবি মুহম্মদ সামাদের লেখা 'বসন্ত এলো যে আজ ঘরে' কবিতাটি আবৃত্তি করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী।
একক কণ্ঠে গান শোনান ইয়াসমিন মুশতারি, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, লাইসা আহমেদ লিসা, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি।
বিমান চন্দ্র যখন শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ গানটি গাইতে শুরু করেন তার সাথে কণ্ঠ মেলান দর্শক সারির অনেকে। নৃত্য ও গানের পরিবেশনার সময় দর্শক সারিতে অনেককে নাচতেও দেখা যায়।
‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো' গানের সাথে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ওয়ার্দা রিহাবের পরিচালনায় ধৃতি নৃত্যালয়। প্রিয়াঙ্কা র্যাচেল প্যারিসের পরিচালনায় গৌড় নৃত্য পরিবেশন করে 'গৌড়ীয় নৃত্য সারথী’।
পূজা সেনগুপ্তের পরিচালনায় আরতি নৃত্য পরিবেশন করে তুরঙ্গমী, লুবনা মরিয়ামের পরিচালনায় সাধনা সংস্কৃতি মণ্ডল পরিবেশন করে 'আহা আজি এ বসন্তে' গানের সাথে নৃত্য। সামিনা হোসেন প্রেমার পরিচালনায় ভাবনা পরিবেশন করে 'মাধবী হঠাৎ কোথা থেকে এলে ফাগুন দিনের শেষে' গানের সাথে নৃত্য।
দলীয় সংগীত পরিবেশন করে গীতাঞ্জলী, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, বহ্নিশিখা, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসের শিল্পীরা।
বিকেলের পর্ব: জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পর্ষদ জানিয়েছে, বিকেল ৪টায় চারুকলার বকুলতলার মঞ্চে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শুরু হয় বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পীদের বসন্ত রাগের ধ্রুপদ খেয়াল পরিবেশনের মধ্যদিয়ে।
পরে দলীয় সংগীত পরিবেশন করে সুরধ্বণি, সুরের ধারা, ভিন্নধারা, উজান, সুরবিহার, নিবেদন, পঞ্চভাস্বর ও সুরসপ্তক। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবে ত্রিশূল, সুরবিহার, পাহাড়ি রঙ, কথক নৃত্য সম্প্রদায়, সৌন্দর্য্য প্রিয়দর্শিনী, একাডেমি অব ফাইন আর্টস, ধ্রুপদ কলা কেন্দ্র, নবচেতনাসহ অনেকে।
একক সংগীত পরিবেশন করেন অণিমা মুক্তি গোমেজ, অণিমা রায়, নিলয় আকাশ, মহাদেব ঘোষ, বিশ্বজিৎ রায়, ফেরদৌসী কাকলি, জিনাত ফেরদৌস, নুসরাত বিনতে নূর, মামুন জাহিদ খান, রিফাত জাহানসহ অনেকে। বাহাদুল শাহ পার্কে বিকেলের পর্বে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেবে শিশু সংগঠন স্বরতরঙ্গ আবৃত্তি ভুবন, গেণ্ডারিয়া কিশলয় কচি-কাঁচার মেলা ও সীমান্ত খেলাঘর আসর।
সেখানে দলীয় সংগীত পরিবেশন করবে স্বপ্তকলির আসর, মরমী লোকগীতি শিল্পীগোষ্ঠী, মহিরুহু, জাগতিক ও নন্দনকুড়ি। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস, স্পন্দন, পুষ্পাঞ্জলী নৃত্যকলা কেন্দ্র ও দনিয়া সবুজ কুড়ি কচি-কাঁচার মেলা।
একক সংগীত পরিবেশন করেন শান্তা সরকার, শ্রাবণী গুহ রায়, প্রদীপ সরকার, দিলদার হোসেন মুক্তার, তাপসী ঘোষ, পিন্টু, শামীম চৌধুরী, ঐশ্বর্য বসাক, তানিয়া, ফারজানা রাণী ও শীর্ষপতি।
একক আবৃত্তি পরিবেশন করবেন পদ্মাবতী দেবী, মাহফুজা আক্তার মীরা, তারেক আলী মিলন ও নুসরাত ইয়াসমিন রুম্পা। আলোচনায় অংশ নেবেন কামাল পাশা চৌধুরী, অমর নাগ ও রেজাউর রহমান সিনহা। উত্তরার বঙ্গবন্ধু উন্মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী, শফিউল গণি, সোলায়মান কবীর, মাহবুব মিঠু। সভাপতিত্ব করবেন মিজানুর রহমান।
পরে দলীয় সংগীত পরিবেশন করবে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, উত্তরা কালচারাল সোসাইটি, উদীচীসহ অনেকে। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবে তাল কালচারাল সেন্টার, অঞ্চলী নৃত্যকলা নিকেতন, ঘুঙ্গুর, অনুপ্রাস খেলাঘর আসর। একক সংগীত পরিবেশন করবেন আনান বাউল, কাওসার আহমেদ, রেজাউল করিম, তামান্না চৌধুরীসহ অনেকে।