ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

শিক্ষার্থী-আনসার সংঘর্ষ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

সরোবর ডেস্ক 

 প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০৮:৫২ রাত  

অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার সাড়ে তিনশ’র বেশি আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার শাহবাগ, রমনা, পল্টন এবং বিমানবন্দর থানায় দায়ের হওয়া বেশ কয়েকটি মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়।

এদিকে, সচিবালয় অবরোধ করা অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে নানান আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে। রোববার রাতের ওই সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষের অর্ধ-শতাধিক মানুষ আহত হন, যাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন এখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়া ওইসব আনসার সদস্যদের উদ্ধার করে রোববার রাতেই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে সেনা সদস্যরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ছয় সেনাসদস্য আহত হয়েছে, যাদের একজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও করা আনসার সদস্যদের ‘মোকাবেলা’ না করলে সেখানকার ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি’ হতে পারতো বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

এদিকে, আন্দোলনকারীরা আনসারদের সঙ্গে ব্যাটালিয়ন আনসারের কোনো সম্পর্ক নেই বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। কিন্তু দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরও আনসার সদস্যরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন কেন? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরুই-বা হলো কীভাবে? অবরুদ্ধ সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক: চাকরি জাতীয়করণ দাবিতে  রোববার সকালে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলকারী আনসার সদস্যরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে।

এরপর দুপুরের মধ্যে প্রায় দশ হাজার আনসার সদস্য সচিবালয়ের মূল ফটক ও আশেপাশের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশ শুরু করে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সরবেন না বলেও ঘোষণা দেন। এতে সচিবালয় রীতিমত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিকেলে জরুরিভিত্তিতে আন্দোলকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

সেখানে তথ্য, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব, ক্রীড়া, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ। অঙ্গীভূত আনসারদের দাবি অনুযায়ী বৈঠকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। ‘সবার সাথে আলোচনা করে আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, এখন থেকে রেস্ট প্রথা থাকবে না আনসারে’-বৈঠক শেষে রোববার সাংবাদিকদের বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আনসারে তিন বছর পরপর বিনা বেতনে ছয় মাসের বাধ্যতামূলক ছুটির যে নিয়ম রয়েছে, সেটিই ‘রেস্ট প্রথা’ নামে পরিচিত। আন্দোলনের শুরু থেকেই আনসার সদস্যরা এটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছিলো।

এছাড়া চাকরি স্থায়ীকরণসহ তাদের আরও যত দাবি রয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। ‘দাবিগুলো পর্যালোচনা করে কমিটি আমাদের কাছে পাঠাবে। এরপর আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বসে একটা সিদ্ধান্ত নেবো’-বলেন চৌধুরী। এসব সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন বৈঠকে অংশ নেওয়া আনসার সদস্যরা। ‘রেস্ট প্রথা বাতিল ঘোষণা করেছে এবং চাকরি জাতীয়করণের জন্য উচ্চতর একটা কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমরা চারজন আনসার সমন্বয়ক আছি...আমরা আপাতত আন্দোলন স্থগিত করতেছি’-সাংবাদিকদের বলেন আনসার জাতীয়করণ আন্দোলনের সমন্বয়ক নাসির মিয়া।

যদিও আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেই পরবর্তীতে আরো কয়েক ঘণ্টা বিক্ষোভ ও অবরোধ অব্যাহত রাখেন আনসার সদস্যরা, যা এক পর্যায়ে সংর্ঘষে পরিণত হয়। ‘হুট করে মারামারি শুরু হয়ে গেলো’- নেতাদের পক্ষ থেকে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পরও কেন বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছিলেন এবং কীভাবে সেটি সংর্ঘষের পর্যায়ে গেলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত বেশ কয়েকজন আনসার সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তারা জানিয়েছেন যে, উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নেতারা আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিলে আনসার সদস্যদের একটি অংশ সেটির বিরোধিতা করেন। ‘চাকরি জাতীয়করণের দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা যেন কেউ সচিবালয়ের গেট না ছাড়ি এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল’- বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আনসার সদস্য মাসুদ হোসাইন (ছদ্মনাম)। নিরাপত্তার স্বার্থে হোসাইন নিজের প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি আরো জানিয়েছেন, চাকরি জাতীয়করণের বিষয়ে লিখিত আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘আমাদের সমন্বয়করা (যারা উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন) থামানোর চেষ্টা করলেও কেউ কথা শোনেনি’-বলেন হোসাইন।

তাহলে সচিবালয়ের বৈঠকে অংশ নেওয়া সমন্বয়কদের পক্ষে কি কেউ ছিল না?

‘ছিল, অনেকেই ছিল’-বলছিলেন ঘটনাস্থলে থাকা আরেক আনসার সদস্য নাজমুল ইসলাম (প্রকৃত নাম নয়)। ‘নিজেদের মধ্যে ঝামেলা লেগে গেছে দেখে আমার মতো অনেকেই তখন দলে দলে চলে গেছে’- বলেন তিনি। আরো জানা যাচ্ছে যে, সংঘর্ষ চলাকালে আনসার সদস্যদের মধ্যে যারা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন ‘রেস্টে থাকা’ আনসার। ‘যাদের চাকরি আছে, তারা চলে আসছে। যাদের চুক্তি শেষ হবে বা রেস্টে আছে, তারা ছিল’-বলেন ইসলাম।

ফটক অবরোধ করে বিক্ষোভ করার কারণে একাধিক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিবসহ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা সচিবালয়ে আটকে পড়েন। বের হতে পারেননি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকও। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়কও সচিবালয়ের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনের একটি দল বিক্ষোভকারী আনসারদের সঙ্গে কথা বলতে যান।

‘তারা এসে সবার সঙ্গে কথা বলার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্তও হয়ে এসেছিল। এর মধ্যে হুট করে মারামারি শুরু হয়ে গেল’-বিবিসি বাংলাকে বলেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া আনসার সদস্য আরিফুল হক (আসল নাম নয়)। সে সময়ের বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকজন আনসার সদস্যকে শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হতে দেখা গেছে। ‘উনাদের (আনসার) কথা ভেবেই আমরা সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। অথচ তারাই আমাদের উপর আক্রমণ করলো’- বিবিসি বাংলাকে বলেন সাকিব আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো দাবি করেছেন আনসার সদস্যরা। ‘ছাত্ররাই আনসার সদস্যদের গায়ে প্রথমে হাতে তুলেছে। এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমরা ধাওয়া দিয়েছি’-বিবিসি বাংলাকে বলেন মোখলেছুর রহমান (প্রকৃত নাম নয়)। সংঘর্ষের একপর্যায়ে রহমান সচিবালয় এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারত‘: শিক্ষার্থীরা আনসার সদস্যদের ‘মোকাবেলা’ না করলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি’ হতে পারতো বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ‘আপনারা তাদের (আনসারদের) যুদ্ধাংদেহী মনোভাব দেখেছেন। তাদের দাবি ছিল এক্ষুণি রাত ১০টার সময় প্রজ্ঞাপন করে তাদের জাতীয়করণ করতে হবে’-সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন. নজরুল।

তিনি আরও বলেন, তারা (আনসার) এমন একটা অসম্ভব দাবি তুলেছিল, অবাস্তব এবং অসম্ভব দাবি করেছিল গণ্ডগোল করার জন্য, সারা সচিবালয় ঘেরাও করে রেখেছিল। হয়ত আরো অনেকে যোগ দিত। ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারতো।’ আনসারদের মধ্যে যারা সহিংসতায় অংশ নিয়েছেন, তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আসেনি বলেও মন্তব্য করে আইন উপদেষ্টা।

‘আমরা মনে করি, কালকে আনসার বাহিনীর ছদ্মাবরণে যারা এসেছিল, কোনো দাবি আদায়ের এজেন্ডা তাদের ছিল না। দাবি আদায়ের এজেন্ডা হয় আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। তারা বারবার আলাপ-আলোচনা করে সম্মত হয়ে ফিরে গেছে। বারবার আমাদের ঘিরে রেখেছে। লাঠি তাদের স্টকে ছিল। এবং আপনারা দেখেছেন, তারা কী মারমুখি ছিল ছাত্রদের উপর’-বলেন নজরুল।

উল্লেখ্য, রোববার দিনভর সচিবালয় ঘেরাও ও শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষের ঘটনার পর বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ে বড় রদবদল করা হয়। বাহিনীটির উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) পদমর্যাদার ৯ জন এবং পরিচালক পদমর্যাদার ১০ কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যেই বদলি করা হয়েছে।

অঙ্গীভূত আনসার কারা : আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশের একটি আধা-সামরিক বাহিনী। সংখ্যার বিচারে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বাহিনীও বটে। সরকারি হিসেবে, বর্তমানে বাংলাদেশে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৬২ লাখেরও বেশি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদস্য। অন্যদিকে, আনসার হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের মধ্যে দুই ধরনের সদস্য রয়েছে। সেগুলো হলো: আনসার ব্যাটালিয়ন এবং অঙ্গীভূত আনসার।

এর মধ্যে আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। আর অঙ্গীভূত আনসার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৪ হাজার।

বাহিনীটির এই দুই ধরনের সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা দেশের অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মতোই স্থায়ীভাবে নিয়োগ এবং সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

আর অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা নিয়োগ পেয়ে থাকে চুক্তির ভিত্তিতে, যেখানে চুক্তির মেয়াদ থাকে তিন বছর। তবে অধিকাংশ সদস্যই চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন।

এক্ষেত্রে বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী, চুক্তি শেষ হওয়ার পর অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে ছয়মাসের ছুটি বা ‘রেস্টে’ যেতে হয়।

কিন্তু ওই ছুটির সময়ে তারা কোনো বেতন কিংবা রেশন পান না। এছাড়া স্বাভাবিক সময়ে দায়িত্ব পালনের জন্য অঙ্গীভূত সদস্যরা দৈনিক ভিত্তিতে অর্থ পেয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। মূলত সে কারণেই ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল করে আনসার ব্যাটালিয়নের মতো স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা। রবিবার সচিবালয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

দৈনিক সরোবর/এএস