ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

রিজার্ভে উন্নতি

রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৪, ০৩:৪৭ দুপুর  

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় চলতি আগস্টের প্রথম তিন দিন রেমিট্যান্স আসে সাড়ে ৯ কোটি ডলার। এর পরের তিন দিন স্থবির ছিল ব্যাংকিং কার্যক্রম। সরকার পতনের পর গত ৭ থেকে ১০ আগস্ট তিনদিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৮ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে চলতি আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৭.৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে জুলাইয়ের প্রথম ২৭ দিনে রেমিট্যান্স আসে ১৫৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। পরে মাসের শেষ চার দিনে তা অনেকটাই বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৯১ কোটি ডলার। সর্বশেষ ড. ইউনূসের নেতৃতাধীন নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থনও জানিয়েছেন প্রবাসীরা। এর প্রভাব দেখা গেছে ৭ থেকে ১০ আগস্টের রেমিট্যান্স প্রবাহে।

প্রবাসীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা করে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ এনে সরব হয়ে ওঠেন। এর প্রভাব পড়ে রেমিট্যান্সে। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। চলতি আগস্টের প্রথম দিকে রেমিট্যান্স আসা থমকে গেলেও পরে তা বেড়েছে বহুগুণে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, আগস্টের প্রথম ১০ দিনে দেশে বৈধপথে ৪৮ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর মধ্যে শুধু ৪ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত এসেছে ৩৮ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ডলার। তথ্য বলছে, আগস্টের প্রথম ৩ দিন পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর ৪ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে প্রবাসীরা ৪৮ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ এ সময়ে আগের ৩ দিনের চেয়ে ৪ গুণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তারা।

তথ্য মতে, চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে একটির (কৃষি ব্যাংক) মাধ্যমে ১ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ডলার এসেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৪২ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা কোনো একটি অর্থবছরে এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।

সরকারের পতনের পর প্রথম ১০ দিনে দেশে বৈধপথে ৪৮ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে

জানা গেছে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতা, অচলাবস্থা আর শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকে পতন- সব মিলিয়ে এক দুর্যোগময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে পুরো দেশ। এ সময়জুড়ে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার পাশে থাকতে বৈধপথ এড়িয়ে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এতে করে টানা তিন মাস দুই বিলিয়নের বেশি আসা রেমিট্যান্স জুলাই মাসে হঠাৎ দুই বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে আসে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হু হু করে বাড়ছে বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ। চলতি আগস্টের প্রথমদিকে রেমিট্যান্স আসা থমকে গেলেও পরে তা বেড়েছে বহুগুণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত মাসে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ফলে প্রবাসীরা কোনো রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেননি। এক পর্যায়ে তারা ঘোষণা দেন যে ব্যাংকিং চ্যানেলে আর রেমিট্যান্স পাঠাবেন না। এমন সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব পড়ে গতমাসের প্রবাসী আয়ে। তবে অন্তর্বর্তী নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন ও ব্যাংকিং চ্যানেল সচল হওয়ায় আবার তারা প্রবাসী আয় দেশে পাঠাচ্ছেন। আর সেজন্য ইতিবাচক ধারা ফিরেছে দেশের অর্থনীতির বড় এই খাতে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, গত বছরে অনেক মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন। তাদের অনেকে এখন রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেছেন। তিনি জানান, গত বছর রেকর্ড প্রায় সাড়ে ১১ লাখ লোক কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। যা আগের বছরের চেয়ে ৮৬ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে জনশক্তি রফতানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সক্ষমতা নেই। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন মন্দ সূচকে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো- বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) মার্চ ও এপ্রিল মাসের দায় মেটানোর পর মে মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকে মোট রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে নেমে আসে। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ নামে ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার। তবে ওই সময় প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ছিল ১৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত আইএমএফের দেওয়া নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ১১ কোটি মার্কিন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আইএমএফ ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলারে নামিয়েছে।

এদিকে রেমিট্যান্স বাড়ার পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেলেও আগস্টের শুরুতে তা ১৪ বিলিয়নের ঘরে উঠেছে। সর্বশেষ রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ২০০ কোটি ৫৭ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় গঠিত বিভিন্ন তহবিলসহ মোট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৪৫২ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিশেষ কাজে দক্ষতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। বৈদেশিক বিনিময় হারের নীতি কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ঠিক করতেও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বস্তুত রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে হুন্ডিওয়ালাদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর প্রতি প্রবাসীদের আগ্রহী করতে নানা ধরনের প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনের উদাহরণ বিবেচনা করা যায়। সর্বোপরি বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোর কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ