ঢাকা, সোমবার, ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১ ভাদ্র ১৪৩১

তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজধানীবাসীর

উন্নয়নযজ্ঞের পরও একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা

এসএম শামসুজ্জোহা 

 প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২৪, ০৮:০৬ রাত  

টানা কিছুক্ষণ ভারী বৃষ্টি হলে ঢাকার কোনো না কোনো এলাকা ডুববে, এটি যেন নিয়ম হয়ে গেছে। অথচ গত চার বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। তবে এত টাকা খরচ করেও ফল শূন্য। জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় রাজধানীবাসীর। বছরের পর বছর যায়, মন্ত্রী-মেয়রের পরিবর্তন হয়। কিন্তু বৃষ্টির মৌসুমে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয় না। নতুন করে জলাবদ্ধতা নিরসন পরিকল্পনাও ফাইলবন্দি। দায়িত্ব, নেতৃত্ব ও কাজের ধরন বদলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর। স্মরণকালের ইতিহাসে সড়কে এত পানি জমতে দেখেননি রাজধানীবাসী। তবেও এখন পর্যন্ত পানি সরেনি বেশকিছু এলাকায়। নগরবাসীর প্রশ্ন বছরজুড়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এত উন্নয়নযজ্ঞের পরও একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা হয় কেন? 

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানীতে ছয়টি সংস্থা ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার খাল ও নর্দমাগুলো পরিষ্কার রাখতে সংস্থাগুলো সঠিকভাবে কাজ করে না। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপায়। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ঢাকায় জলাবদ্ধতার ভয়ংকর রূপ দেখেছে নগরবাসী। তারা জানান, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন শুধু ভূরি ভূরি পরিকল্পনা করে রাষ্ট্রের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, রাজধানীতে জলাবদ্ধতার মূলে নগরবাসীর সচেতনতার অভাব। যত্রতত্র ময়লা ফেলে, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার নগরে জলাবদ্ধতার মূল কারণ। তাই নগরবাসীর সচেতনতাই পারে ঢাকাকে এমন পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ রাখতে। এসব ময়লা ও প্লাস্টিক ড্রেন ও খালে গিয়ে ব্লক তৈরি করে। যার কারণে পানি নামতে পারে না। আর যখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এছাড়াও সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে তা দ্রুত নিষ্কাশন করার সক্ষমতা রয়েছে সিটি করপোরেশনের। এর থেকে বেশি হলে হিমশিম খেতে হয় তাদের। ঢাকার পশ্চিত তেজতুরী বাজার গার্ডেন রোডের বাসিন্দা আসলাম শেখ বলেন, বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার পর আমাদের এলাকায় দেখা গেছে তোশক, বালিশসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী জিনিসপত্র ড্রেনের সামনে জমে আছে। মূলত এসব কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। সিটি করপোরেশন যেমন তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে না আমরা জনগণও নিজেদের দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল নই। হলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য মন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা যে আশ্বাস দেন; তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। তারা নিজেরাও জানেন না, ঢাকায় কত মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কোন অংশে কতটুকু জলাবদ্ধতা হবে। এ থেকে রক্ষার জন্য তারা সেভাবে কাজও করছেন না। বিভিন্ন সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প নিয়ে যে কাজ করছে; তাতে শুধু জনগণের টাকাই নষ্ট হচ্ছে, প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং জলাশয় অবশিষ্ট আছে; সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জলাশয় ভরাট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

দুই সিটির ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয়। সমন্বয়ের অভাবে জলাবদ্ধতার ভয়ঙ্কর রূপ দেখছে নগরবাসী

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নেওয়া বড় প্রকল্প ছাড়াও জলাবদ্ধতা কমাতে দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকার জেলা প্রশাসনের নিয়মিত কিছু ব্যয় আছে। ঢাকার খাল, নর্দমা, ড্রেন সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন খাতে এসব প্রতিষ্ঠান টাকা খরচ করে থাকে। গত ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসা থেকে ২৬টি খাল ও ড্রেনেজ সিস্টেম দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হয়। জলাবদ্ধতা কেন হয়, কোন কোন জায়গায় হয়; তা নিয়ে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশন কোনো কাজ করেনি। ২০১৬ সালে ঢাকা ওয়াসার তৈরি করা ‘স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান ফর ঢাকা সিটি’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই নতুন মাস্টারপ্ল্যান নিতে যাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। সংস্থা দুটির দাবি; বিদ্যমান ওয়াসার প্ল্যান অকার্যকর।

রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, এলাকার অনেক বাড়ি থেকে দুদিন কেউ বেরই হতে পারেননি। খুব প্রয়োজনে যারা বের হয়েছেন তারা হাঁটু পানি মাড়িয়ে এখানে-ওখানে গেছেন। আমাদের সারা জীবন জলাবদ্ধতার মধ্যে চলাফেরা করতে হয়। আগেও জলাবদ্ধতা ছিল; এখনো জলাবদ্ধতা আছে। তবে এখন পানি জমে থাকার সময়সীমা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এ সমস্যা থেকে স্থায়ী মুক্তি চাই। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব জলাধারই ভরাট হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই যখন ভরাট করে; তখন অন্যরা কী করবে? ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেন, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় ১৬১টি স্থান নির্ধারণ করেছি, এর মধ্যে ১০৯টি স্থানে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করা হয়েছে এবং ২৬টি স্থানে চলমান ও আরও ২৬টি কাজ আগামী অর্থবছরে করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি বলেন, পানি নামতে দিতে হবে। এজন্য নর্দমা লাইন, বক্স কালভার্ট, খাল, নদী পর্যন্ত লাইন তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।

অতীতে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আমি প্রমিজ করছি; সামনের বছর থেকে আর জলাবদ্ধতা দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘোষণার পর সাত বছর পেরিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দুই মেয়াদে এসেছেন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসী মুক্তি পাননি; বরং জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে ঢাকার মেয়ররা সাফল্যের দাবি করছেন। গতবছর ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ওয়ারীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, চলতি বছর বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলেও ১৫ মিনিটের মধ্যে পানি নিষ্কাশন হবে। কিন্তু রাজধানীতে বৃষ্টি হলে কোনো কোনো এলাকায় পানি ২৪ ঘণ্টায় সরে না।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ৩৮৫ কিলোমিটার গভীর ড্রেন ও ৪টি পাম্প স্টেশন এবং ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট। পানি উন্নয়ন বোর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করে ৫২টি স্লুইস গেট এবং ১টি পাম্প স্টেশন, রাজউক রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৫ কিলোমিটার লেক এবং ৩০০ কিলোমিটার জলাশয়। ডিএনসিসির ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে এবং ডিএসসিসির রয়েছে ৯৬১ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এ ছাড়া বর্তমানে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় দেওয়া হয়েছে ২৬টি খাল। তবে সব খাল ও ড্রেনেজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভরাট হয়ে যায়। তাই অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

দনৈকি সরোবর/ কএেমএএ