ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১

দলগুলোর দরকাষাকষিতে সরব রাজনীতির মাঠ

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ০৮:১৫ রাত  

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলই সক্রিয়ভাবে মাঠে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারেনি। হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়ে দলগুলোর নেতাকর্মীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক আওয়ামী লীগ বাদে বিএনপি, জামায়াত, বিভিন্ন জোট, ইসলামী ও বাম ঘরানার দলগুলোর সরব উপস্থিতিতে রাজনীতির মাঠ যেন আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নিয়েও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশে গরম ও সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই বিপ্লবের পর আবারো গরম হচ্ছে দেশের রাজপথ। সংস্কার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে আনাসহ বেশ কিছু ইস্যুতে সারা দেশে প্রতিদিনই চলছে মিছিল-সমাবেশ। এসব সভা-সমাবেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের শক্তির জানান দিচ্ছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের ইতি ঘটে। 

বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর দরকাষাকষিতে সরব হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ ও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছরে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে গেছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা প্রয়োজন। আমি মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাহলেই গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে এবং বর্তমান উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সহজ হবে।

জানা গেছে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সারা দেশের জেলায় জেলায় জনসমাবেশ করছে নিত্যপণ্যের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে আনা, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা, ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত বন্ধ করা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী দলটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে সারা দেশের মহানগর জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের সকল জেলায় জেলায় চলছে সমাবেশ। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতারা এসব সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে জনমত গঠন করছেন। 

নানা হিসাব-নিকাশে পিছিয়ে নেই রাজনৈতিক দলগুলো। দরকষাকষির সরব উপস্থিতিতে জমেছে রাজনীতির মাঠ  

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার হতাশা কাটিয়ে দলীয় কর্মীরা সারা দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব হয়েছেন। একই সঙ্গে দলের অনেকে রাজনৈতিক মাঠের দখল নিতে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন। তবে ইমেজ ধরে রাখতে এসব অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা যেমন নেওয়া হচ্ছে; তেমনি সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই সভা-সমাবেশের মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে চাঙ্গা রাখছে দলটি। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, দেশি-বিদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে যেমন দেখা করছেন দলীয় প্রধান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তেমনি কেন্দ্রীয় অনেক নেতার সঙ্গেও হচ্ছে বৈঠক। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। 

রাজধানীর পল্টনে আয়োজিত সমাবেশে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সকল বৈষম্যের কবর রচনা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দয়া করে আমাদের দিকে কেউ আর চোখ রাঙানি দেবেন না। ফ্যাসিবাদের ভাষায় কথা বলবেন না। আমাদের ভদ্রতাকে যেন দুর্বলতা মনে না করেন। ভদ্রতা যখন শক্ত হয়, তা কেমন হয় দেশের জনগণ সাড়ে ১৫ বছর পরে টের পেয়েছে। জীবন দিয়েছি কিন্তু জামায়াতে ইসলামী কোন কুশক্তির সঙ্গে আপস করেনি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, এখন মান্ধাতা আমলের রাজনীতি বাদ দিয়ে গুণগত পরিবর্তন দরকার। শেখ হাসিনার দমনপীড়নের অবসান হওয়ায় দলগুলোর রাজনীতিতে গতি এসেছে; এটা ভালো। বর্তমান সরকারকে সবাই সমর্থন দিলেও কোনো কোনো দল আগে সংস্কার চায়, কেউ কেউ চায় নির্বাচনের রূপরেখা। এজন্য কতদিন সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে; তা-ও পরিষ্কার নয়। আবার সংস্কারের কর্মসূচি কী কী; তা-ও অজানা। সুতরাং দলগুলোর অবস্থান তখন কী হবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। সংস্কারগুলো জনবান্ধব না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী হয়; তারপর নির্ভর করবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

সম্প্রতি এক জনসভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে তাকের রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে দারুণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে; তা নস্যাৎ করতে এখনো সক্রিয় দেশি-বিদেশি চক্র ও কিছু রাজনৈতিক দল। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হয়; ততক্ষণ পর্যন্ত নেতাকর্মীকে মাঠে থাকতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে সারা দেশের মহানগর জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। 

এদিকে পদত্যাগী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির আগে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দল বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনকে নিবন্ধন দেওয়ায় জমে উঠেছে ছোট দলগুলোর রাজনীতিও। রাজনীতিতে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে পিছিয়ে নেই ১২ দলীয় জোট, ইসলামী দলগুলোও। এই দরকষাকষিতে জমে উঠেছে খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, জাকের পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইনসানিয়াত বিপ্লবের মতো ইসলামী দলগুলো। 

বর্তমান রাজনীতির মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের উদ্যোগে আসছে নতুন ছাত্রসংগঠন। তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে নতুন এই ছাত্রসংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি হবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি সংগঠন। স্টুডেন্টস ফার্স্ট, বাংলাদেশ ফার্স্ট নীতিতে ছাত্র-নাগরিকের স্বার্থকে বাস্তবায়নের প্রয়াসই হবে এই ছাত্রসংগঠনের মূলমন্ত্র। বলা হচ্ছে- নতুন ছাত্রসংগঠনের আদর্শগত ও চেতনাগত ভিত্তি হবে এই ভূখন্ডের ইতিহাসের সব গণ-আন্দোলন। নতুন ছাত্ররাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চাকে পুনর্বহাল করে শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়িত করার প্ল্যাটফর্মগুলোকে পুনর্গঠন করা হবে। নিয়মিত এবং নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন অব্যাহত রাখার জন্য নতুন ছাত্রসংগঠন সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সরকারে বিরোধী দলে থাকলেও রাজনীতির মাঠে তারাও পিছিয়ে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যেমন বৈঠক করছে; তেমনি দলীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। তবে মাঠে নেই টানা চারবারের সরকারে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ। তবে অন্যসব প্রধান রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা।