ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

পণ্যের দাম বাড়লেও উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না: ঢাকা চেম্বার

সরোবর ডেস্ক

 প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৪, ০৭:২৩ বিকাল  

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড্ ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণের মূল্যের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষনের লক্ষ্যে পণ্যের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) অডিটোরিয়ামে ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণে গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করে ডিসিসিআই। 

অনুষ্ঠানে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়লেও উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না। কখনও কখনও দাম বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ খরচ জড়িত হয়, তিনি  উল্লেখ করেন। আমরা যদি স্টোরেজ, পরিবহন এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে উৎপাদন খরচ কমাতে পারি, তাহলে দাম তুলনামূলকভাবে কমে আসবে বলে ডিসিসিআই সভাপতি মত প্রকাশ করেন। অধিকন্তু, তিনি পচনশীল পণ্যের অপচয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, শুধুমাত্র প্রক্রিয়াকরণ এই বিশাল ক্ষতি রোধের জন্য একটি ভালো সমাধান হতে পারে। এছাড়া তিনি একটি নিখুঁত নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য যথাযথ সরবরাহ এবং চাহিদাভিত্তিক তথ্যপ্রাপ্তি, তথ্য বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি একটি ট্যারিফ ক্যালেন্ডার প্রণয়নের প্রস্তাবনা পেশ করেন। এর মাধ্যমে দেশীয় মৌসুম ছাড়াও পূর্বঘোষিত সময়সীমা অনুসারে আমদানি শুল্ক হ্রাস অথবা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
 
তিনি বলেন, এ বিষয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সামগ্রিক সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি পণ্য উৎপাদনের চিহ্নিতকরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। 

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২০-২৯ আগস্ট দেশের ৮টি বিভাগের ৪৯টি জেলায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়, যেখানে ৬০০ জনের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে উৎপদানকারী, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছেন। গবেষণায় সর্বমোট ২১টি খাদ্যপণ্যের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ১২টি স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত, ৫টি আমদানিকৃত এবং বাকি ৪টি স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানি করা হয়। এটি একটি বেসলাইন সমীক্ষা হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল, যেখানে উৎপাদক, আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

পণ্য উৎপাদন খরচের ক্রমাগত উচ্চ মূল্য, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, পণ্য পরিবহনের উচ্চ হার, বাজার আধিপত্য এবং উৎপাদনকারীদের খুচরা বাজারে প্রবেশাধিকার স্বল্প সুযোগ প্রভৃতি কারণে আমাদের স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও কৃত্রিম সংকট, ঋণপত্র খোলায় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা, টাকার মূল্যমান হ্রাস, সাপ্লাইচেইন ব্যবস্থায় অদক্ষতা প্রভৃতি বিষয়গুলো পণ্য মূল্য ওঠানামায় ভূমিকা রাখছে। জরিপে দেখা যায়, উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির চাপ পড়ায় উৎপাদক পর্যায়ে মোটা চাল, মিহি চাল, পেঁয়াাজ, রুই মাছ ও আলু, মসুর ডাল, কাঁচা মরিচ, হলুদ, লাল মরিচ, আদা ও রসুনের মতো বেশির ভাগ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, জোগান এবং আমদানির সমন্বয়হীনতার কারণেও অনেকক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, তথ্যের অসামঞ্জস্যতা, স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন হ্রাস, সার, বীজ, তেল ও কীটনাশকের উচ্চ মূল্য এবং জেলাভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মূল্যস্ফীতি রোধে সরকারকে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সময়মত পণ্য পরিবহন নিশ্চিতকল্পে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পণ্য সংরক্ষণ বাড়াতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় স্টোরোজ সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি সাপ্লাইচেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন অপরিহার্য বলে মনে করে, ডিসিসিআই।   

ঢাকা চেম্বারের নির্বাহী সচিব (গবেষণা) একেএম আসাদুজ্জান পাটোয়ারী সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কম সরবরাহ, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ এবং বাজারের আধিপত্য, সীমিত দর কষাকষির ক্ষমতা এই গবেষণায় উঠে এসেছে। কৃত্রিম সংকট, এলসি খোলার সমস্যা, মৌসুমি পণ্যের মূল্যের তারতম্য, টাকার অবমূল্যায়ন, সরবরাহ চেইনের অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা এবং উৎপাদকদের সীমিত বাজারে প্রবেশাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো পণ্যের মূল্য ওঠানামার জন্য দায়ী। বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হলো প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। এছাড়াও, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা এবং তথ্যের অসামঞ্জস্যতা, স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস এবং উচ্চ পরিবহন খরচ, কীটনাশক সহ সার-বীজ-তেল এবং ওষুধের উচ্চ মূল্য এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর  সুনিদিষ্ট তথ্য ভিত্তিক গবেষণা পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে, যেন সরকার কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়। খাদ্য পণ্য সমমমতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে আরো ভালো পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো, পণ্যের অপচয় রোধে আরো স্টোরেজ সুবিধা সম্প্রসারিত করার উপর জোরারোপ করা হয়।

সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস্ উইং-এর যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারফি কমিশনের যুগ্ম প্রধান মশিউল আলম এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর উপ-পরিচালক (সেনসাস উইং) স্বজন হায়দার প্রমুখ অংশগ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র উপ-পরিচালক (সেনসাস উইং) স্বজন হায়দার বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে দেশব্যাপী প্রায় ৩৪২টি পণ্যের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, এক্ষেত্রে পণ্যের সরবরাহ ও দামের মধ্যকার একটি কার্যকর যোগশাজসের বিষয়টি তীব্রভাবে প্রতীয়মান রয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস বলেন, শুধুমাত্র মুদ্রানীতি দিয়ে পণ্যের মূল্য কমানো সম্ভব নয়, এজন্য সরকারকে প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। তিনি আরোও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৯বার পলিসি রেট পরিবর্তন করলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন উল্লেখজনক নয়। 

তিনি উল্লেখ করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে আমদানির বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি, কারণ কোভিড পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাপ্লাইচেইন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচেছ, যার প্রভাব পড়ছে আমাদের স্থানীয় পণ্য উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস্ উইং-এর যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, আমাদের বাৎসরিক পণ্য ভিত্তিক কোন ‘প্রডাক্ট ক্যালেন্ডার’ নেই, তবে পরিসংখ্যান ভিত্তিক এ ধরনের থাকলে সরকারের পক্ষে পণ্য আমদানি শুল্কায়ন সহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সহজতর হতো। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিবছর আমাদের আবাদি জমি ১ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে, ফলে কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ক্রমাগত হারে কমে যাচ্ছে, এর কারণে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। তিনি বলেন, বতর্মানে কৃষিখাতে আমাদের ভর্তুকি ৪-৫ শতাংশ, যেটিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় ১০ শতাংশে  উন্নীত করা সম্ভব হলে, স্থানীয় উৎপাদনশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া তিনি ক্রস বর্ডার বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনায়ন, আমদানি খরচ হ্রাস, বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা সম্প্রসারণ, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা বাড়ানো প্রভৃতির ওপর জোরারোপ করেন।  
 
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মশিউল আলম বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে আমরা  পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকি, তবে ‘সিজিওন্যাল ট্যারিফ’ অথবা ‘ট্যারিফ ক্যালেন্ডার’ প্রবর্তনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মৌসুমে শুল্ক কমানো বা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, ফলে আমাদের উৎপাদকরা যেমন উপকৃত হবেন সেই সাথে পণ্য আমদানি প্রক্রিয়াও সহজতর করা সম্ভব।

দৈনিক সরোবর/এএস