ঢাকা, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ে জনমনে ক্ষোভ  

এসএম শামসুজ্জোহা

 প্রকাশিত: মার্চ ০৩, ২০২৫, ০৭:১৫ বিকাল  

আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে জীবন। দুই বছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে। রমজানে নিত্যপণ্যের উচ্চ দামে দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে পারছে না। বাংলাদশে গত কয়েক মাসে আলু, চাল, ডাল, তেল ডিম, পেঁয়াজ ও সবজিসহ সব পণ্যের মূল্য নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এবারের রমজানে ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে মূল্যস্ফীতি। উচ্চ দামের কারণে মধ্যবিত্তের প্রায় নাভিশ্বাস অবস্থা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাবার অন্যতম কারণ ছিল, বাজারে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা। কারণ ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ অন্যতম ব্যতিক্রম।

সূত্র মতে, শাক-ভাতের সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে মধ্যম আয়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস! কে দেখে তাদের চোখের জল? বিনিদ্র রাতের মানুষগুলোর অন্তর্মুখী রক্তক্ষরণ কে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসবে? সমাজ-সংসারে বৈষম্য দেখে দেখে সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সংসার চালাতে সাধারণ মানুষের ঋণের ওপর যেমন নির্ভরতা বাড়ছে; তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাশা। এর অন্যতম প্রধান কারণ সীমিত রোজগার, অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা এবং মূল্যস্ফীতি।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার টিসিবির মাধ্যমে প্রায় এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীদের জন্য কম মূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও আলু কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে সারাদেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে ৩০ টাকা দরে চাল দেওয়ার কর্মসূচি আছে। টিসিবিরি ট্রাকের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখে বোঝা যায়, বাজারে উচ্চ পণ্যমূল্য মানুষকে কতটা বিপাকে ফেলেছে। সরবরাহ ব্যবস্থায় থাকা পক্ষগুলো যার যার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। নীতি নির্ধারকরা আশার কথা শোনাচ্ছেন, কিছু উদ্যোগও নিয়েছেন। কিন্তু বাজার শান্ত হচ্ছে না। শুধু দরিদ্র শ্রেণি নয়, মধ্যবিত্তের অনেকেই এখন বাজার তালিকা ছেটে ফেলছেন। অনেকেই পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছেন না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সার্বিকভাবে জনসংখ্যার পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সমাজ-সংসারে বৈষম্য দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। এতে ঋণের ওপর যেমন নির্ভরতা বাড়ছে; তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাশা

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি বন্ধ করা যায়নি। দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট ভাঙা এখনো সম্ভব হয়নি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। এরই মধ্যে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ভ্যাট আরোপের ফলে দাম বাড়বে না। কিন্তু দাম ঠিকই বেড়েছে। প্রতিবছর রমজান ঘিরে পণ্যের দাম বাড়ে। এবারও সেই আশঙ্কা রয়ে গেছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ৫ জানুয়ারি মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, গেল নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক তিন-আট শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক আট শতাংশ। আর শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, যা ১৪ দশমিক ছয়-তিন শতাংশ। এত উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি এই মুহুর্তে খুব কম দেশেই আছে। সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত জুলাই মাসে ১৪ দশমিক এক শতাংশ হয়, যা অন্তত গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২০১১ সালের মার্চ মাসে এটি ১৩ দশমিক আট শতাংশে পৌছায়। 

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকে বড় দুটি অগ্রাধিকার ঘোষণা করে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন উদ্যোগ স্বত্ত্বেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কেন বাগে আসছে না তা নিয়ে সরকারের মধ্যেই অস্বস্তি রয়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে এবং এই দাম বাড়ানোর বিষয়টি পুরোপুরি ঐচ্ছিক। তার মতে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তেলের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয় এরকম খাতের পরিচালকরাও তাদের পণ্য বা সেবার দাম বাড়াবে। যেমন- বাড়ি ভাড়া অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি। তিনি বলেন, ‘মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর ওপর এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব খুবই ভয়াবহ হবে।’

রাজধানীতে বসবাস করা তাশদিক হাসান তার বর্তমান আর্থিক চাপের বিষয়ে বলেন, আমি বুঝাতে পারব না কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এবারের রমজানে আয়ের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে করব জানি না। তিনি বলেন, আয় একই থাকলেও এক বছর আগের তুলনায় তার শুধু খাবারের খরচই বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

তাশদিকের মতো নিম্ন থেকে মধ্য আয়ের মানুষ অর্থনীতির চাকার ধীর গতি ও মূল্যস্ফীতির সমস্যায় জর্জরিত। এবারের রমজানে সকল নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সব কিছুর দামও চড়া। এটার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের প্রভাবে তারা খুবই সমস্যায় পড়েছে।

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বেসরকারি চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন আয়ের মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, খাবারের খরচ কমানো, যতটা সম্ভব চিকিৎসা না নেওয়া এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে বিভিন্ন উৎস থেকে ধার নেওয়া। দৈনিক রোজগারের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের অবস্থা এতটাই করুণ হয়েছে যে, তাদেরকে খাবারের পরিমাণ কমাতে হয়েছে। 

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে একটি কাঠামোগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে এর সমাধান হবে না। বাজারে পণ্যের প্রকৃত চাহিদা নিরুপন করে পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা- এই তিনের যথাযথ সমন্বয় ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বাজারের সাথে সম্পৃক্ত সরকারি সংস্থাগুলোকে এক যোগে কাজ করতে হবে। টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। শুল্ক কমানোর পরও কেন বাজারে প্রভাব পড়ছে না, এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে। পণ্য পরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

রিকশা চালক রহিম শেখ (৪৫) বলেন, ‘আমাদের কোনো রোজা-ঈদ নাই; এখন শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাই। কখনো কখনো শুধু চাল-ডালের খিচুড়ি খাই। মাছ বা মাংস কেনার সামর্থ্য আমার নেই।’ রহিম এক সময় গাইবান্ধার একজন অবস্থাপন্ন চাষি ছিলেন। এখন তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করেন। এর মধ্য থেকে রিকশার মালিককে ১৫০ টাকা দিতে হয়। কঠোর পরিশ্রমের কাজ হওয়ায় প্রতিদিন তিনি রিকশা নিয়ে বের হতে পারেন না। যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি বাধ্য হন খাদ্য ও চিকিৎসার পেছনে খরচ কমাতে। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে আমার মতো মানুষকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

দৈনিক সরোবর/কেএমএএ